হযরত ওসমান (রা.)-এর উদারতা সম্পর্কে একটি সুন্দর ঘটনা।


আশারাহ্ মুবাশশারাহ্


হযরত ওসমান (রা.)-এর উদারতা

হযরত ওসমান (রা) এতো অধিক সম্পদশালী ছিলেন যে, তাঁকে গনী অর্থাৎ ধনবান- এ বিশেষ বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছিল। গনী তাঁর নামের অংশ নয়। তিনি পরম বিত্তশালী ছিলেন বলেই তাঁকে গনী বলা হত ।

হযরত ওসমান (রা) কি তাঁর যা কিছু ধন-সম্পদ ছিল, নিজেকে সে সবের মালিক মনে করতেন? তিনি কি কখনও এক মুহূর্তের জন্য ভাবতেন, এসব সম্পদ আমার এবং আমি তা নিজের আরাম-আয়েশের জন্যে বা নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করতে পারি?

এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর ঘটনা আছে। একবার একজন অতি দরিদ্র ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (স)-এর কাছে এসে কিছু চাইলেন। রাসূল (স)-এর কাছে তখন দেওয়ার মত কিছুই ছিল না। তিনি তাঁকে পাঠালেন হযরত ওসমান (রা)-এর কাছে।

লোকটি হযরত ওসমান (রা)-এর বাড়িতে যখন পৌঁছল তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। লোকটি শুনতে পেল যে, হযরত ওসমান (রা) তাঁর একজন ভূত্যকে বলছেন যে, বাতির সলিতা যেন ছোট করে দেওয়া হয়। কারণ, আলো উজ্জ্বলভাবে জ্বললে বেশি তেল খরচ হবে। লোকটি ভাবলো, যদিও সে নিঃস্ব, তবু তার ঘরে মাটির প্রদীপ আরও উজ্জ্বলভাবে জ্বলে। সে ভাবল, ওসমান (রা) ধনী হতে পারেন, কিন্তু বড়ই কৃপণ। এতো বড় কৃপণের কাছে কিছু চাইতে তার মন চাইল না ৷

সে ব্যক্তি পরদিন আবার রাসূল (স)-এর কাছে গিয়ে কিছু চাইল। রাসূল (স) জানতে চাইলেন যে, সে ওসমান (রা)-এর কাছে গিয়েছিল কি না। সে জানাল যে, ওসমান বড় কৃপণ এবং তার মনে হয় না যে, তিনি তাকে কোন সাহায্য করবেন। কিন্তু রাসূল (স) তাকে বলে-কয়ে আবার ওসমান (রা)-এর গৃহে পাঠালেন।

এবার সে দেখলো যে, ওসমান (রা)-এর আস্তিনায় তুলা রৌদ্রে দিয়ে জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কিছু কিছু তুলার আঁশ জালের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। হযরত ওসমান (রা) ঐ আঁশগুলো ধরে ধরে এনে আবার জালের মধ্যে ঢোকাচ্ছেন। লোকটি এবারও আশ্চর্যান্বিত হল

তুলা রোদে দিলে কিছু আঁশতো উড়ে যাবেই। তাই বলে সে আঁশগুলো হাওয়া থেকে কুড়িয়ে এনে আবার জাল চাপা দেওয়া এ কাজ শুধু কৃপণেরাই করে থাকে। লোকটি এবারও হযরত ওসমান (রা)-এর কাছে কিছু চাইলো না। কারণ সে ভাবতেই পারল না, এমন হিসেবী লোক কিছু দান করতে পারে। তাই সে আবার রাসূল (স)-এর কাছে গিয়ে তাঁর কাছে যা আছে তা থেকেই কিছু দান করার আবেদন জানান ।

তখন রাসূল (স)-এর কাছে দেওয়ার মত কিছুই ছিল না। তিনি আবার লোকটিকে বলে-কয়ে ওসমানের বাড়িতে পাঠালেন। লোকটি এবারে যা দেখলেন, “তাতে তার চোখ একদম ছানাবড়া। পিপীলিকার দল খাদ্যশস্যের স্তূপ থেকে কিছু শস্যের দানা নিয়ে যাচ্ছিল। হযরত ওসমান (রা) পিপীলিকার মুখ থেকে সেসব শস্যের দানা খুঁটে নিয়ে একটা স্তূপে রাখলেন। আর কতকগুলো পিঁপড়ার গর্তের কাছে রেখেও দিলেন । লোকটি ভাবল, কতবড় কৃপণ হলে পিঁপড়ার মুখ থেকে শস্য দানা খুঁটে নেওয়া সম্ভব হয় । তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, এমন লোক কিছু দান করতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লোকটি ছিল বিদেশী মুসাফির।

তবু যেহেতু রাসূল (স) বার বার করে তাকে এই ওসমানের কাছেই পাঠাচ্ছেন তাই কৃপণের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে সে এবারে হযরত ওসমান (রা)-কে জানালো যে, রাসূল (স) তাকে তাঁর কাছে এই জন্য পাঠিয়েছেন যাতে তিনি তার অভাব মুক্তির ব্যবস্থা করেন।

লোকটার কথা শুনে হযরত ওসমান (রা) ভাবলেন, কী দেওয়া যায়। কয়েক মুহূর্ত পর দেখলেন যে, দূর দিগন্তের পারে কৃষ্ণ রেখা দেখা যাচ্ছে। বাণিজ্য কাফেলা বলেই মনে হল। আগন্তুককে তিনি একটু অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কাফেলা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তিনি বুঝতে পারলেন যে, বিদেশ ফেরত এই বাণিজ্য কাফেলা তাঁরই। তিনি একখণ্ড চিরকুট লোকটিকে দিলেন। চিরকুটে কাফেলা পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, সবচেয়ে ভালো উটটি যেন পিঠের সব মাল-সামানসহ চিরকুটবাহককে দিয়ে দেওয়া হয়।

চিরকুট হাতে পেয়ে লোকটি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিল, ওসমান (রা) বোধ হয় তার সঙ্গে তামাসা করছেন। তাই সে জানালো যে, সে তো তার নিজের ইচ্ছায় তাঁর কাছে আসেনি, রাসূল (স) পাঠিয়েছেন, তাই এসেছেন। সুতরাং এভাবে তাকে অযথা হয়রান না করে ঘরে যা আছে তা থেকেই কিছু দিয়ে দেওয়া হোক। চিরকুটসহ হযরত ওসমান তাকে আগত কাফেলার পরিচালকের নিকট যাওয়ার কথাই বললেন এবং মাল-সামানাসহ উটটি নেওয়ার জন্যে অনুরোধ জানালেন। কারণ, তাকে স্বয়ং রাসূল (স) পাঠিয়েছেন তার অভাবমুক্তির জন্যে। ঘরে যা আছে তা সন্তোষজনক নয়।

লোকটি অগত্যা চিরকুট নিয়ে বিদায় হল। মনে মনে ভাবলো, যে হাড়-কৃপণগিরি দেখা গেছে, তাতে দেরি করলে ওসমান (রা) হয়ত মত পরিবর্তন করে তাকে সামান্য কিছু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার জন্যে বলবেন এবং তার চিরকুট ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে আসবেন ।

যাহোক লোকটি অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে চিরকুটখানা কাফেলার অধিনায়কের হাতে তুলে দিল। হযরত ওসমানের চিরকুট দেখতে পেয়ে অধিনায়ক আগন্তুককে তার ইচ্ছামত কাফেলা থেকে একটি উট নিয়ে যাওয়ার জন্যে বললেন। লোকটি দেখে শুনে কাফেলার প্রথম উটটিকেই নেবে বলে ঠিক করল। কিন্তু মুশকিল হল, কাফেলার প্রথম উটটিকে দল হতে কিছুতেই পৃথক করা গেল না। কারণ, কাফেলাতে প্রথম উট হল নেতা উট, সকল উটই তাকে অনুসরণ করে বলা হল, কাফেলার উটগুলো আস্তাবলে রাখার পর সে যেন তার পছন্দমত প্রথম উটটি নিয়ে যায়। লোকটি বিরক্ত হয়ে আবার ওসমান (রা)-এর বাড়িতে এসে কিছু দানের দাবি জানালো। কাফেলার প্রথম উট গ্রহণের ঝামেলার কথাও সে জানালো।

ইতোমধ্যে কাফেলার অধিনায়কও এসে পড়েছিলেন। ঘটনা শুনে হযরত ওসমান (রা) মনে মনে বললেন যে, আল্লাহর বোধ হয় ইচ্ছা যে, আগন্তুক কাফেলার সবগুলো উট ও মালমাত্তা পায়। এই বলে তিনি তাঁকে কাফেলার চল্লিশটি উট এবং সমস্ত বাণিজ্য দ্রব্যাদি দিয়ে দিলেন। আগন্তুক তো হতভম্ব। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না এমনটা সম্ভব হতে পারে হযরত ওসমান (রা) তাকে চল্লিশটি উট ও সমুদয় সম্পদ নিয়ে যেতে বার বার অনুরোধ জানাতে লাগলেন। লোকটি তখন ইতোপূর্বে তিন তিন বার ওসমান (রা)-এর যে কাণ্ড দেখেছে সেগুলোর কথা ব্যক্ত করল এবং জানাল যে, ওসব ঘটনা এবং এ বিরাট দানের মধ্যে সে কোন সামঞ্জস্য বা মিল খুঁজে পাচ্ছে না ।

হযরত ওসমান (রা) তখন বললেন যে, সম্পদের মালিকতো আল্লাহ্। তিনি শুধু পাহারাদার বা জিম্মাদার মাত্র। এ সম্পদ তার জিম্মাদারিতে থাকাকালে যদি কোন অপচয় ঘটে, তাহলে আল্লাহ্র কাছে তাকে হিসাব দিতে হবে। কিন্তু আল্লাহ্র সম্পদ আল্লাহর অপর কোন বান্দাকে দিয়ে দিলে আল্লাহতো সন্তুষ্টই হবেন, হিসাব চাইবেন না। তাই প্রদীপের সলিতা বেশি জ্বালিয়ে বা বাতাসে তুলা উড়ে চলে যেতে দিয়ে সম্পদ নষ্ট হতে দিতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য তাঁর কোন বান্দাকে যে কোন পরিমাণ সম্পদই দিয়ে দিতে পারেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url