সাম্যের প্রতীক, মানবদরদী হযরত আলী (রা.)।


আশারাহ্ মুবাশশারাহ্


সাম্যের প্রতীক হযরত আলী

হারিস ইবনে সোহাইল প্রাদেশিক শাসনকর্তা। সরকারি কাজে তিনি রাজধানী কুফায় আগমন করেছেন। এক অপরাহ্ণে তিনি অশ্বে আরোহণ করে রাজপথে চলেছেন। হঠাৎ খলীফার সঙ্গে পথিমধ্যে সাক্ষাৎ। তিনি আমীরুল মুমিমিনকে সম্মান প্রদর্শন মানসে অশ্ব হতে অবতরণ করলেন।

হযরত আলী (রা) স্বীয় অশ্বের গতিরোধ করলেন। হারিসকে সম্বোধন করে বললেন, “কোন মানুষেরই জন্যে এটা শোভনীয় নয় যে, তিনি আল্লাহ্ ব্যতীত অপর কোন মানুষের প্রতি হীনতা প্রকাশ করেন। আপনি আপনার অশ্বে আরোহণ করুন।"

আপনি যদি রাষ্ট্রীয় কর্মচারী না হতেন, তবুও আমি আশা করতাম না যে, আপনি হীনতা প্রকাশ করে আমায় সম্মান প্রদর্শন করুন। মানুষের হনীতা প্রকাশের দৃশ্য কখনও আমাকে আনন্দ দেয় না। আমি মনে করি, মানুষের উপরে মানুষের এ এক নিকৃষ্ট যুলুম ৷”

আরবের সমকালীন প্রচলিত আইনে যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে যারা মুক্তিপণ প্রদান করতে পারত না, তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জিম্মায় বণ্টিত হত। ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য অমুসলমানদের হাতে যে সব মুসলিম ব্যক্তিরা বন্দি হত, তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হত। অমুসলিম বন্দিরাও মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে বিতরিত হত। তাদের সুযোগ-সুবিধা সম্বন্ধে রাসূল (স)-এর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, “তোমরা যে কাপড় পরবে তাদেরও তেমনি কাপড় পরতে দেবে। তোমরা যে খাবার খাবে তাদেরও তেমনি খাবার খেতে দেবে।” কাজেই, এদের মধ্যে এবং মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে জীবনযাত্রার মানে কোন পার্থক্য থাকতো না; বরং তাদের উন্নততর অবস্থায় রাখা হত। তারা আজাদী পাওয়ার পর অনেকে নিজের আত্মীয় স্বজনের কাছে ফিরে যেত না।

মানবদরদী হযরত আলী

হযরত আলী (রা)-এর পরিবারে এরূপ তিন জন যুদ্ধবন্দি আশ্রয় পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন সাঈদ (র), কামর (র) ও ফিজ্জা (র)। তাঁরা আলী (রা)-এর পরিবারে মানবপ্রেমের যে উৎসের সন্ধান পেয়েছিলেন, তা পরিত্যাগ করে আর কোথাও যাননি। হযরত আলী (রা)-এর সংস্পর্শে থেকে তাঁরাও ক্রমশ নানা মহৎ জ্ঞানে মহিমামণ্ডিত হয়ে উঠেন। তাঁদের প্রতি হযরত আলী (রা)-এর ব্যবহারের স্বরূপ হযরত সাঈদ (র) বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেন

“ভীষণ গরমের দিন। হযরত আলী (রা) গৃহাভ্যন্তরে বসে পত্র লিখছিলেন। আমি বাইরে উপবিষ্ট। পত্র লেখাকালে তিনি কয়েকজন রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাঁদের ডেকে আনার জন্যে আমাকে তিনি কয়েকবার ডাকলেন। আমি ইচ্ছাপূর্বক কোন সাড়া দিলাম না। অতঃপর তিনি তাদেরকে ডাকার জন্যে নিজেই বের হয়ে এলেন। আমাকে দরোজার কাছে উপবিষ্ট দেখতে পেয়ে শুধালেন, কেন আমি তার পুনঃপুন আহ্বানে সাড়া দেইনি। আমি বললাম, “আমি দেখতে চেয়েছিলাম আপনি কখন রাগেন এবং রাগলে আপনাকে কেমন দেখায়, কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হল না।” হযরত আলী (রা) স্মিত হাসি হেসে বললেন, “এসব ছেলেমানুষী দিয়ে তুমি আমায় রাগাতে পারবে না, বন্ধু!” আজাদী প্রাপ্ত দাস সাঈদ (র) খলীফা আলী (রা)-এর শাহাদত পর্যন্ত তাঁরই সংসারে ছিলেন।

হযরত আলী (রা)-এর ভৃত্য হযরত কাম্বার (র) বর্ণনা করেছেন, “জীবনে একটিবার মাত্র হযরত আলী (রা) আমার উপর রাগ করেন। ঘটনাটা ঘটেছিল যখন আমি কয়েকটি মুদ্রা জমিয়ে রেখেছিলাম। বায়তুল মাল থেকে আমার অংশ হিসেবে প্রাপ্ত মুদ্রার কয়েকটি আমি ব্যয় করিনি। ওগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছিল। হযরত আলী (রা)-এর দেওয়া কয়েকটি মুদ্রা। সবগুলো মিলে দাঁড়িয়েছিল একশ দিরহাম। অনেকগুলো মুদ্রা জমেছে দেখে আমি উৎফুল্ল হয়ে হাসতে থাকি। অকস্মাৎ আমার হাসি মিলিয়ে গেল। আলী (রা)-কে মনে হল রাগান্বিত এবং ব্যথিত। আমি তাঁকে তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করলাম।”

তিনি জবাবে বললেন, “কাম্বার ! যদি তোমার এ মুদ্রার কোন প্রয়োজন না থেকে থাকে, তুমি কি তোমার চারপাশে এমন কোন লোক দেখনি যাদের এ মুদ্রার প্রয়োজন থাকতে পারে। তাদের মধ্যে হয়ত কেউ ছিল ক্ষুধায় পীড়িত, চলৎশক্তিহীন। এ মুদ্রার অধিকার থেকে তুমি তাদের বঞ্চিত করেছ। আমি কখনও ভাবিনি তুমি অতো হৃদয়হীন ও কঠোর হবে এবং সম্পদকে সম্পদের জন্যেই ভালোবাসবে। আফসোস কাম্বার! আমার ভয় হয়, ইসলামের মর্মবাণী তুমি কিছুই গ্রহণ করতে পারছ না। আরো মনোযোগী হও। আন্তরিকভাবে ইসলামের মর্মবাণী বোঝার চেষ্টা কর । এই মুদ্রা এ গৃহ থেকে এখনই বের করে নাও।”

“আমি মুদ্রাগুলো নিয়ে কুফার মসজিদে গেলাম এবং দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দিলাম।”

হযরত ফাতিমা (রা) ছিলেন তৎকালীন আরবের সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী ধনাঢ্য মহিলা হযরত খাদিজা (রা)-এর তনয়া। কয়েকটি ফলের বাগান তিনি মায়ের সম্পদ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। বীর আলী (রা) সমকালীন সরকটি যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। মালে গণীমাত হিসেবে প্রাপ্ত যুদ্ধ সামগ্রীর পরিমাণ ছিল প্রচুর, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন তাঁরা যাপন করেননি। দিনের পর দিন তাঁদের উনুনে আগুন জ্বলতো না । দরিদ্র, বিকলাঙ্গ, নিরন্ন, নিঃস্বদের জন্যে তাঁদের সম্পদের প্রায় সবটুকু নিঃশেষ হয়ে যেত। সর্বহারা মিস্কীনদের মধ্যে সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে আলী (রা)-এর পরিবার দিনের পর দিন ভুখা থাকতেন ।

আলী-ফাতিমা (রা)-এর জীবনের একমাত্র বিলাসিতা ছিল আল্লাহ্র ইবাদত ।

হযরত সালমান (রা) আলী পরিবার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “কী অদ্ভুত সংসার! রাসূল তনয়া এবং বীর আলী নিঃস্ব শ্রমিকের জীবন যাপন করছেন। যে সম্পদ প্রতিদিন তাঁরা বিলিয়ে দেন, তাঁর এক-দশমাংশও যদি তাঁরা নিজের জন্যে ব্যয় করতেন, বেশ আরামে থাকতে পারতেন।”

ফিজ্জা (রা) নাম্নী হযরত ফাতিমার এক চাকরানী ছিলেন। ব্যবস্থা এই ছিল যে, একদিন হযরত ফাতিমা (রা), আর একদিন হযরত ফিজ্জা (রা) সাংসারিক কাজ করবেন। যদি কখনও ঘটনাক্রমে হযরত ফিজ্জা (রা)-এর অবকাশ দিনে হযরত ফাতিমা (রা) পীড়িত হতেন, তবে ফিজ্জা (রা)-কে কাজ করতে দেওয়া হতো না । সেদিন হযরত আলী (রা) নিজে যব ভাঙতেন, উনুন জ্বালাতেন, এবং সংসারের অন্যান্য কাজ করতেন। রুটি তৈরি করতেন

প্রখর মধ্যাহ্ন। হযরত আলী (রা) কুফার রাজপথে চলছেন। এক অসহায় বালিকা ক্রন্দনরতা। খলীফা এগিয়ে গেলেন। সস্নেহে বালিকার মনোবেদনার কারণ জানতে চাইলেন। বালিকাটি অশ্রু বিগলিত নেত্রে তাঁকে জানাল যে, তার মনিব খেজুর খরিদ করার জন্যে তাকে বাজারে পাঠিয়েছিল। ক্রীত খেজুর ছিল নিকৃষ্ট মানের। মনিব খেজুর গ্রহণের অস্বীকৃত হয় এবং মূল্য ফিরিয়ে আনতে হুকুম দেয়। খেজুর বিক্রেতা খেজুর ফিরিয়ে নিতে অনিচ্ছুক। বালিকা একদিকে মনিবের হাতে প্রহৃত হচ্ছে এবং অন্যদিকে নিষ্ঠুর খেজুরবিক্রেতার নিকট খাচ্ছে বেত্রাঘাত। সে এখন বুঝতে পারছে না কি করবে, কোথায় সাহায্যের জন্যে হাত বাড়াবে।

খলীফা প্রথমেই অসহায় বালিকাকে নিয়ে খেজুরবিক্রেতার কাছে গেলেন এবং খেজুরগুলো ফেরত নিতে অনুরোধ জানালেন, কিন্তু ক্রুদ্ধ ফল বিক্রেতা তার কর্কশ কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়িয়ে দিল । কুফায় নব আগন্তুক বিধায় সে খলীফাকে চিনত না। ফল বিক্রেতার রূঢ় ব্যবহার ও কর্কশ কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কয়েক ব্যক্তি সেখানে হাযির হল এবং খলীফার পরিচয় প্রদান করল।

মুহুর্তে ফল বিক্রেতার মনোভাবের অদ্ভূত ও আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে গেল। দোকান থেকে লাফিয়ে খলীফার সামনে এসে সে নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করা শুরু করল এবং অসহায় বালিকাকে তার মূল্য ফিরিয়ে দিতে চাইল ।

হযরত আলী (রা) ফলবিক্রেতাকে লক্ষ্য করে বললেন, “ঘৃণ্য ও ঔদ্ধতা সহকারে সৎ ও ন্যায্য পরামর্শ প্রত্যাখ্যান, আর ক্ষমতা ও শক্তির নিকট এত হীন, এত করুণভাবে আত্মসমর্পণ যেমন অমানবিক তেমনি নীচতার পরিচায়ক।"

এদিকে বালিকাটির মনিবও খবর পেয়ে খলীফার কাছে দৌড়ে এল এবং স্বীয় নির্মম ব্যবহারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল। খলীফা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, “অধীনস্থ ব্যক্তির প্রতি আপনি বেরহম এবং দরদহীন। ক্ষুদ্র বালিকার একটি ভুল আপনি ক্ষমা করতে পারেন না। আপনার কী অধিকার আছে যে, আপনি আল্লাহ্ ক্ষমা আশা করতে পারেন? একমাত্র নামের পরিচিতি ছাড়া ইসলামী আদর্শ হতে আর কিছুই আপনি অর্জন করতে পারেননি।”

অন্য একদিনের ঘটনা। খলীফা কৃষ্ণার পথে চলছেন। তিনি দেখলেন এক শীর্ণকায় বৃদ্ধা জ্বালানি কাঠের বোঝা মাথায় করে এগিয়ে চলেছে। বোঝাটি তার জরামান্ত দেহের পক্ষে ছিল খুবই ভারী। খলীফা কাছে এসে বৃদ্ধার ভারী বোঝাটি নিজের মাথায় তুলে নেন এবং বৃদ্ধাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। নিঃসঙ্গ সংসারে বৃদ্ধার কাজ করার কেউ ছিল না। খলীফা বৃদ্ধার উনুনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ছোট খাটো কাজ করে দিচ্ছিলেন, আর বৃদ্ধা তাঁকে প্রাণ ভরে দোয়া করছিলেন। সে সময়ে এক প্রতিবেশী বৃদ্ধার কুটিরে উপস্থিত হন। তিনি বৃদ্ধাকে খলীফার পরিচয় প্রদান করেন, অনুগত ভৃত্যটি যে বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের খলীফা, তা জানতে পেরে বৃদ্ধা বিশ্বয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন।

আত্মীয় স্বজন-পরিত্যক্ত এবং লোকালয় থেকে বিতাড়িত এক কুষ্ঠ রোগী শহর থেকে দূরে পর্বত গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার দু'টি হাতই খসে গিয়েছিল। পরিক্রমকালে খলীফা আলী (রা) একদিন এই কুষ্ঠ রোগীর সন্ধান পান। তারপর প্রতিদিনই খলীফা উক্ত গুহায় গমন করতেন। সময়ে সময়ে তাকে গোসল করাতেন, ক্ষত ধুয়ে বেঁধে দিতেন, প্রতিদিন পিঠে করে তাকে বহন করে গুহার বাইরে আনতেন যাতে রুগ্ন ব্যক্তি কিছুক্ষণ মুক্ত আলো বাতাস পেতে পারেন। খলীফার এ সেবা ছিল জ্বিন মানুষের অগোচরে। তাঁর শাহাদতের পর ঘটনাটি প্রকাশ পায়। খলীফার শাহাদাতের দিন কয়েকজন লোক উক্ত গুহায় লোকটির সাক্ষাৎ পায়। রুগ্ন ব্যক্তি খলীফার খবর জিজ্ঞাসা করেন। খলীফা আততায়ীর হস্তে নিহত হয়েছেন শোনামাত্র তীব্র বেদনায় লোকটি আর্তচিৎকার করে ওঠেন এবং মৃত্যুবরণ করেন।

খারেজী আততায়ীয় হস্তে আহত হওয়ার পর খিলাফতের ঘোরতর শত্রু এই খারেজীদের সম্পর্কে খলীফা নির্দেশ দিয়ে যান - "আমার মৃত্যুর পর হত্যার মানসে খারেজীদের সন্ধানে ধাবিত হয়ো না। পাপ-পঙ্কিল জীবনযাত্রা এবং মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে জীবন অতিবাহিত করার চেয়ে সত্য পথ অনুসন্ধানে বহির্গত হয়ে পথভ্রষ্ট হওয়াও শ্রেয়।”

এক জুমুআর দিন। খলীফা খোতবা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আপতিত হল পুত্র হাসান ও হোসাইনের দেহের উপর। তাঁরা দামি চাদর পরে মসজিদে এসেছেন। খলীফা খোতবা দানে ক্ষান্ত হলেন। ছেলেদের জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ চাদর তারা কোথায় পেয়েছেন। জানা গেল কোন এক ধনী ব্যক্তি তাদের এগুলো উপঢৌকন দিয়েছে। চাদর দু'টি সঙ্গে সঙ্গেই হাসান (রা) এবং হোসাইন (রা)-এর দেহ থেকে অপসারিত হল এবং বায়তুল মালের খাজাঞ্চির হাতে চলে গেল । খলীফা তনয়কে কোন প্রকার উপঢৌকন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দেওয়াটাই স্বাভাবিক ।

আহওয়াজ প্রদেশ। খলীফা সৈন্য-সামন্ত নিয়ে কোন এক অভিযানে বেরিয়েছেন । আহওয়াজবাসীরা শায়েখদের নেতৃত্বে খলীফার কাফেলাকে সাদর সম্ভাষণ জানান । তাঁদের অভিলাষ হল খলীফার সৈন্যবাহিনীকে আপ্যায়িত করা এবং কয়েকটি মূল্যবান ফারসী ঘোড়া উপঢৌকন দেওয়া। খলীফা অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি তাঁদের সম্বোধন করে বললেন, “আপনারা খারাজ পরিশোধ করেছেন। এর পর আপনাদের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করা অপরাধ, যদিও আপনারা এগুলো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আনন্দিত চিত্তে প্রদান করছেন।”

আহওয়াজবাসীগণ অতিথিবৎসল। তাদের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান তাঁদের জন্যে মর্যাদাহানিকর মনে করা হত । অগত্যা খলীফা তাঁদের প্রদত্ত উৎকৃষ্ট অশ্বগুলো গ্রহণ করলেন, কিন্তু অশ্বগুলোর মূল্যের পরিমাণ খারাজ তিনি মাফ করে দিলেন। তিনি তাদের আয়োজিত আতিথ্য গ্রহণ করলেন বটে, কিন্তু তার ব্যয় যুদ্ধ- বাজেট থেকে প্রদানের নির্দেশ দিলেন।

প্রতি সরকারি কর্মচারীদের ব্যবহার সম্বন্ধে খলীফা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। দুনিয়ায় সর্বযুগেই দেখা যায়, সরকারি আমলাগণ জনগণের ভৃত্য হওয়া সত্ত্বেও জনগণের উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। খলীফা হযরত আলী (রা) রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের কার্যাবলি অত্যন্ত সূক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। জনগণের প্রতি দুর্বিনীত ব্যবহার, অবহেলা, অলসতা ও অযোগ্যতার জন্যে তনি আমলাদের কঠোর শাস্তি দিতেন। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের কার্য পর্যবেক্ষণের জন্যে তিনি বিশেষ কর্মচারী নিয়োগ করতেন। তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত এবং কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগ শ্রবণ করে খলীফার কাছে তার রিপোর্ট প্রদান করত।

বসরার গভর্নর যিয়াদ ইবনে আবিহে যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু স্বভাবের দিক থেকে তিনি ছিলেন খানিকটা কঠোর প্রকৃতির। খলীফা তাঁকে একবার তাঁর কঠোরতা সম্বন্ধে সাবধান করে দেন, কিন্তু পুনরায় তাঁর বিরুদ্ধে রিপোর্ট পেয়ে খলীফা লেখেন, “কসম করছি, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র নামে কসম করছি, তোমার বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার হরণের আর কোন অভিযোগ যদি আমার নিকট পৌঁছে, তবে তোমাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে যা তুমি কল্পনা করতে পারো না। তোমার মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে, তোমার কোন উপায় অবলম্বনই থাকবে না।"

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) প্রাদেশিক গভর্নর ছিলেন। একবার কতিপয় অমুসলিম কৃষক খলীফার কাছে গভর্নরের অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ আনেন ।

খলীফা আলী (রা) আমীর আবদুল্লাহকে লেখেন, “আপনার প্রদেশের কৃষকেরা আপনার বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক রূঢ় আচরণের অভিযোগ করেছে। তাদের অভিযোগের মধ্যে আমার মনে হয় সত্য নিহিত আছে। মধুর ব্যবহার পাওয়ার হক তাদের রয়েছে। পূর্বে তাদের সঙ্গে যদি ভালো ব্যবহারও করে থাকেন, আমার পত্র পাওয়ার পর তাদের সঙ্গে আরো ভালো ব্যবহার করবেন । আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্ণ সুযোগ যেন তাদের থাকে। তাদের সঙ্গে বিনীত ও ভদ্রভাবে সাক্ষাৎ করুন। তারা কাফের এবং বহু দেবতার উপাসনাকারী হতে পারে, কিন্তু তারা মানুষ, তাদের সঙ্গে রূঢ় ও কর্কশ ব্যবহার করার কোন অধিাকর আমাদের নেই।”

বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধিবৃন্দও আমীর আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের (রা) বিরুদ্ধে রূঢ় ব্যবহারের অভিযোগ আনেন। খলীফা ইবনে আব্বাসকে লেখেন, “জনগণের সঙ্গে আপনার ব্যবহার পশুসুলভ হবে, এ কখনও সংগত হতে পারে না- কখনই নয়। তারা সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের সঙ্গে সম্ভ্রম ও মর্যাদাসহকারে ব্যবহার করা এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। আপনি আমার প্রতিনিধি। আপনার ব্যবহার আমার ব্যবহার বলেই জনগণের কাছে গণ্য হবে। যাদের উপর আপনি শাসন পরিচালনা করছেন, তাদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের প্রচেষ্টাই আপনার প্রধান দায়িত্ব। মর্যাদা, সৌজন্য ও বিবেচনার সঙ্গে ব্যবহার করাই আপনার কর্তব্য।"

প্রাদেশিক গভর্নর মানযার ইবনে যায়েদকে হযরত আলী (রা) বার বার সাবধান করে দেন, কিন্তু তাঁর বিশেষ উন্নতি হয়নি। খলীফা অবশেষে তাঁকে অপসারিত করেন।

খলীফা আমীর মানযারকে লিখেছিলেন, “তোমার পিতার ন্যায়পরায়ণতা ও সততার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের জন্যই আমি তোমাকে নিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছি। ভেবেছিলাম, পিতার ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও অন্যান্য মহৎ গুণের অন্তত কিয়দংশ তুমি পাবে, কিন্তু আমি ভুল করেছি। পরম পরিতাপের সঙ্গে আমি অবগত হয়েছি, তুমি তোমার লোভ সংবরণ করতে পারনি। পৃথিবীর সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মানের জন্যে তুমি পরকাল বিসর্জন দিয়েছ। পার্থিব লোভের জন্যে দীন ত্যাগ করেছ।”

“তোমার সম্বন্ধে যা জেনেছি তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, তোমার পায়ের জুতা জোড়া এবং তোমার বাড়ির উটটিও তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এর পর কোন অঞ্চলের বা কোন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব তোমাকে অর্পণ করা সঙ্গত নয়। কোন আমানতের যোগ্যই তুমি নও। তোমার স্বভাব ও মানসিকতা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে তোমার দ্বারা যে কোন আমানতের খেয়ানত সম্ভব। পত্র পাওয়া মাত্র দায়িত্ব ভার বুঝিয়ে দিয়ে তুমি আমার নিকট চলে এসো।”

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url