মানবতার দুয়ারে হযরত আলী (রা.)-এর বীরত্ব ও মুয়াবিয়ার ঘটনা।


আশারাহ্ মুবাশশারাহ্


মানবতার দুয়ারে হযরত আলীর বীরত্ব

জামালের যুদ্ধ । হযরত আলী (রা) বীরবিক্রমে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, শ্রান্ত । ভৃত্য কাম্বার খানিকটা মিষ্টি সিরাপ নিয়ে হযরত আলীর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "জনাব! প্রখর রৌদ্রে আপনি অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছেন। আপনি তৃষ্ণার্ত এবং ক্লান্ত এ শরবত পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করুন।”

সতৃষ্ণ নয়নে হযরত আলী (রা) শরবতের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কাম্বারকে বললেন, “চেয়ে দেখো, আমার চারদিকে মৃত্যুপথযাত্রী তৃষ্ণার্ত কত মানব সন্তান! আমাকে শরবত পান না করিয়ে দু'তিন জন লোক সাথে নিয়ে যাও, আর এদেরকে ঠাণ্ডা পানি পান করাও।”

কাম্বার বললেন, “জনাব! এরা তো সবাই আপনার শত্রুপক্ষীয় লোক।" হযরতআলী (রা) বললেন, “তা ঠিক, কিন্তু তারাও মানুষ। তাদের সেবা কর।"

সিফ্ফিনের যুদ্ধ। হযরত আলী (রা)-এর বাহিনী এসে পৌঁছবার আগেই হযরত মুয়াবিয়া সসৈন্যে ফোরাত তীরে উপনীত হন। তাঁর উদ্দেশ্য, ফোরাতের তীর অবরোধ করে ধূসর মরুর বুকে আলী (রা)-এর বাহিনীকে নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করা। আলীর বাহিনী নদী-তীরে উপস্থিত হয়ে অবগত হল, একবিন্দু পানিও তাদের ভাগ্যে জুটবে না।

হযরত আলী (রা) হযরত মুয়াবিয়াকে বলে পাঠালেন, তাঁর ঐ কাজ ইসলাম ও মানবতা-বিরোধী । হযরত মুয়াবিয়া জবাব পাঠালেন, যুদ্ধ যুদ্ধই। তাতে মানবতার আদর্শ এবং ইসলামের নীতিমালা গৃহীত হতে পারে না। তাঁর উদ্দেশ্য, আলী (রা) কে বধ করা এবং তাঁর সৈন্যদলকে ভীত সন্ত্রস্ত করা। নদীর পানি বন্ধ করে দিলে সে উদ্দেশ্য সাধন সহজ এবং দ্রুত হবে ।

খলীফা আলী (রা) প্রিয় পুত্র হোসাইনকে আক্রমণ চালাতে নির্দেশ দেন। প্রবল আক্রমণের পর সমস্ত নদী তীর অধিকৃত হল। মুয়াবিয়ার শিবিরে পানি সমস্যা অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠল ।

এবারে মুয়াবিয়া (রা) পানির জন্য আলীর (রা) কাছে দূত পাঠালেন। দূতের মাধ্যমে হযরত আলী (রা) জানালেন, যখনই যতটুকু পানির প্রয়োজন, মুয়াবিয়ার সৈন্যগণ তা নিতে পারবে। তিনি নিজের সৈন্যদলকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন মুয়াবিয়ার পানি বহনকারী সৈন্যদের বাধা না দেয়।

হযরত আলী (রা)-এর কয়েকজন সেনাপতি মুয়াবিয়া বাহিনীকে পানি সরবরাহে আপত্তি জানালেন। তাঁদের যুক্তি, যেহেতু মুয়াবিয়া তাঁদের পানি সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছেন, সেহেতু মুয়াবিয়াকে পানি সরবরাহ না করা অসঙ্গত নয়। ন্যায়ের দৃষ্টিতে যে যেরূপ সেরূপ ব্যবহারই তার প্রাপ্য।

হযরত আলী (রা) জবাবে বললেন, “তারা অমানুষের মত ব্যবহার করেছে। কেউ অমানুষিক ব্যবহার করলে আমি তো তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারি না। আমি আমার চরম শত্রুকেও খাদ্য ও পানি প্রদানে অস্বীকৃতি জানাতে পারি না। তারা আমার শত্রু, কিন্তু সব কিছুর উপরে তারা তো মানুষ।”

৩৯-৪০ হিজরী। মুয়াবিয়া খিলাফতের উত্তর সীমান্ত প্রদেশসমূহে আক্রমণের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেন। এ উদ্দেশে আগে থেকেই মুয়াবিয়া (রা) কিছু বর্গী-দল-উপদল সৃষ্টি করেছিলেন । তিনি ছিলেন পুরোপুরি রাজনৈতিক ব্যক্তি । সীমান্ত অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হল। জনগণ খিলাফতের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধনসম্পদ আর প্রাণরক্ষার তাগিদে মুয়াবিয়ার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করল এবং খিলাফতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল । হায়েতের গভর্নর কুযাইল খলীফা আলী (রা)-কে জানালেন যে, মুয়াবিয়ার সিরীয় সীমান্তে অনুরূপ অভিযান চালানো না হলে তিনি এরূপ ঘৃণ্য পন্থা পরিহার করবেন না।

খলীফা আলী (রা) কুযাইলকে লিখলেন, “আপনার মত লোকের কাছ থেকে আমি এ ধরনের প্রস্তাব আশা করিনি। 'মুয়াবিয়ার এলাকা লুণ্ঠনের পরিবর্তে আমাদের নিজের এলাকার লোকদের নিরাপত্তার জন্যে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করা মহোত্তম পন্থা । কাদের সম্পদ আপনি লুণ্ঠন করবেন? তাদের মধ্যে তো থাকবে নিরীহ জনসাধারণ, নারী ও শিশু। আমরা কিভাবে তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারি, তাদের হত্যা করতে পারি? না, কখনই না। না স্বপ্নেও এরূপ কল্পনা করবেন না, কখনই না। তারা আমাদের শত্রুপক্ষীয় লোক হতে পারে; কিন্তু তারা তো মানুষ।”

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url