সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে হযরত ওমর (রা.)-এর ভূমিকা কি ছিল, ইসলামে সংখ্যালঘুদের অধিকার।


আশারাহ্ মুবাশশারাহ্

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী


জনগণের জীবিকাঃ খিলাফতের দায়িত্ব

বর্তমান যুগে কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের বাইরে কোথাও সরকার জনগণের জীবিকার দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করে না। অবশ্য সব ধরনের সরকারেরই ঘোষিত নীতি থাকে কোনো নাগরিককে অনাহারে মরতে না দেওয়া।

খলীফা ওমর (রা) নিজেকে তাঁর খিলাফতের অধীন সমস্ত লোকজনের জীবিকার জন্য দায়ী মনে করতেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন অংশ ঘুরে বেড়াতেন- খিলাফতের কোথাও কোনো ব্যক্তি অভুক্ত আছে কিনা তা দেখার জন্য। ক্ষুধার্ত নাগরিকের জন্যে পিঠে করে খাদ্যদ্রব্য বহন করেও নিজ কর্তব্য পূর্ণভাবে পালন করেছেন বলে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না। একবার কোনো অভুক্তের গৃহে খাদ্য বহন করে নেওয়ার সময় তাঁর অনুচর সেই খাদ্যের বোঝাটা খলীফার পিঠ থেকে নিতে চাইলে খলীফা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, শেষ হিসাবের দিন কি সে খলীফার পাপের বোঝা বহন করবে? খিলাফতের কেউ অভুক্ত থাকলে তিনি নিজেকেই দায়ী মনে করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। বর্তমান সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো উন্নত হয়েছে যে, জনগণের খবরের জন্যে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় না। ঘরে বসেই কোথায় কে অভুক্ত আছে, অভাব-অনটনে আছে, সে খবর পাওয়া যায়, কিন্তু সেই শাসক কোথায়?

১৮ হিজরীতে মদীনায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষাবস্থায় খলীফা ওমর (রা) বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যসম্ভার অতি দ্রুত আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফতুহুল বুলদানে উল্লিখিত আছে, খলীফা মনে করতেন, দুর্ভিক্ষে যে সমস্ত লোক অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হবে তাদের জন্য খলীফাকেই দায়ী হতে হবে। মূর্ভিক্ষ থাকাকালীন একদিনও খলীফা মাংস খাননি। তিনি করুণভাবে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন, "হে আল্লাহ্! আমার পাপ এবং অযোগ্যতার দরুন মুহাম্মদ (স)-এর উম্মতকে ধ্বংস করো না।” বিকলাঙ্গ, অসুস্থ ও বৃদ্ধ প্রত্যেকের জন্যে পৃথক পৃথক ভাতার ব্যবস্থা ছিল। পথচারী এবং বিকলাঙ্গ জরাগ্রস্তদের জন্য সাধারণ ভোজশালা খোলা ছিল।

১৮ হিজরীতে খলীফা নির্দেশ জারি করেন যে, পরিত্যক্ত ছেলে-মেয়েদের জন্য বায়তুল মাল থেকে ভাতা দেওয়া হবে। এ ভাতার পরিমাণ ১০০ দিরহাম থেকে শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতো।

কিতাবুল বারাজে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে খলীফা ওমরের একটি ফরমানের উল্লেখ আছে। এ ফরমানে তিনি লিখেছেন, “আমি তাদের এ অধিকার দিয়েছি যে, যখন কোনো বয়সের ভারে কাজের অনুপযুক্ত হয়, অথবা কোনো দুর্বিপাকে পড়ে পবিত্র হয়ে যায় এবং এমন অবস্থায় পতিত হয় যে, তার আপনজনদের নিকটও করুণার বস্তুতে পরিণত হয়, তখন তার জিযিয়া রহিত হবে এবং তার পরিবার বায়তুল মাল থেকে জীবিকার সংস্থান পাবে।

খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব সরকারের বলেও খলীফার বিশ্বাস ছিল । খলীফা একবার বলেছিলেন, “যদি ফোরাতের তীরে একটি কুকুরও অনাহারে মারা যায়, ওমরকে তার জন্যও আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে।” তেরশ বছর পূর্বে জনগণের জীবিকার জন্য দায়িত্ববোধের যে ইসলামী আদর্শ খলীফা ওমর (রা) স্থাপন করেছিলেন, বর্তমান শতাব্দীতে খুব কম দেশেই সে রকম দায়িত্ববোধ পরিলক্ষিত হয়। পরম পরিতাপের বিষয়, বর্তমান শতাব্দীতে উন্নত সভ্যতার এই যুগেও অসংখ্য আদম সন্তান কুকুর অপেক্ষা অবহেলিত জীবনযাপন করছে।

সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে খলীফা ওমর (রা) পথিপার্শ্বে এক তাঁবুর কাছে দাঁড়িয়ে লোকজনের খবর নিচ্ছিলেন। এক বুড়িকে তাঁবু থেকে বের হয়ে আসতে দেখে ওমর (রা) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে খলীফার কোন খবর জানে কিনা। বুড়ি জবাব দিল, “হ্যাঁ খলীফা সিরিয়া হতে রওয়ানা হয়েছে বলে শুনেছি। তার উপর আল্লাহ্র অভিসম্পাত, আমি এ পর্যন্ত তার কাছ থেকে এক দিরহামও পাইনি।” ওমর প্রতিবাদ করে বললেন, “অতো দূর বলেই হয়ত খলীফা তোমার সংবাদ নিতে পারেননি।” বুড়ি জবাবে বলল, “খলীফা যদি জনগণের দুঃখ-দুর্দশার খবর না রাখতে পারে, তবে সে খলীফা হয়েছে কেন ?”

ওমর (রা)-এর খিলাফতের প্রথম দিকেও (তখনও বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠিত হয়নি) এক বেদুঈন খলীফার নিকট এসে বলল, “ওহে ওমর! বেহেশতের আনন্দই সর্বোচ্চ আনন্দ। আমার মেয়েদের এবং তাদের মাকে বস্ত্র দাও। এটা তোমাকে দিতে হবে।” খলীফা বললেন, “যদি না দেওয়া হয় তবে কি হবে।” বেদুঈন জওয়াব দেয়, “তোমাকে আমার সম্বন্ধে বিচারের দিন জবাবদিহি করতে হবে এবং সেদিন তোমার কোনো জবাবই থাকবে না।” একথা শুনে খলীফা অভিভূত হয়ে পড়লেন এবং নিজ দায়িত্বের গুরুত্ব চিন্তা করে তিনি এমনভাবে কাঁদতে শুরু করলেন যে, তাঁর শ্মশ্রু সিক্ত হয়ে উঠল।

খলীফার কাছে তখন বেদুঈনকে দেওয়ার মত কিছুই ছিল না। নিজের জামাটি খুলে তিনি বেদুঈনকে দান করলেন।

হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতের একটি ঘটনা থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণের জীবিকার ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব সম্বন্ধে সম্যক ধারণা হবে। খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের অধিকার আল্-কুরআন স্বীকৃত মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকারের বাস্তবায়ন ইসলামী রাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্র এই অধিকার স্বীকার না করে এবং জনগণের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ না করবে, সে পর্যন্ত সে রাষ্ট্রকে কিছুতেই ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে না । খলীফা ওমর (রা)-এর খিলাফতকালে ইসলামী রাষ্ট্রের এই বাস্তব রূপায়ণের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়। আজ বিশ্বব্যাপী, বিশেষত এশিয়া আফ্রিকার অনুন্নত দেশসমূহের কোটি কোটি অর্ধভুক্ত, অনশনক্লিষ্ট বঞ্চিত মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্যে প্রয়োজন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। আর এ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য দরকার ফারুকী খিলাফতের আদর্শে গঠিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রবর্তনের নিরলস সংগ্রাম।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url