হযরত আবু বকর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর কেমন জীবন-যাপন করতেন, কেমন ছিলো খলিফাদের আদর্শ এবং নীতি।


আশারাহ্ মুবাশশারাহ্

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী


খলীফার বেতন

হযরত আবূ বকর (রা) পেশায় ছিলেন বস্ত্র-ব্যবসায়ী। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরদিন তিনি দৈনন্দিন জীবিকা অর্জনের জন্য কাপড় বিক্রয় করতে বাজারে যাচ্ছিলেন। হযরত ওমর (রা) তা দেখতে পেয়ে বললেন যে, খলীফা যদি ব্যক্তিগত কাজে জীবিকা অর্জনে সময় ব্যয় করেন, তবে সরকারি কাজের অসুবিধা হতে পারে। হযরত ওমর (রা) খলীফাকে বায়তুল মাল থেকে ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তাঁরা দু'জনেই বায়তুল মাল যে ব্যক্তির আমানতে ছিল সেই ব্যক্তি হযরত আবূ ওবায়দার (রা) নিকট যান। হযরত ওমর (রা) খলীফাকে ভাতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁকে বুঝিয়ে বলেন। হযরত আবূ ওবায়দা বললেন, মুহাজিরদের যে ভাতা দেওয়া হয়, সে পরিমাণ ভাতা আমি খলীফাকে দিতে পারি; তবে মুহাজিরদের যে সর্বাধিক নিকট বা যাকে সর্বাধিক ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে, খলীফাকে তা দেওয়া হবে না, তার চেয়ে কম দেওয়া হবে । অতঃপর আবূ উবায়দা (রা) খলীফাকে লক্ষ্য করে বলেন, “আপনাকে গ্রীষ্ম ও শীতের জন্য দু'টি জামা দেওয়া হবে, একটি ছিড়ে গেলে তা ফেরত দিলেই তার পরিবর্তে আপনি আর একটি পাবেন।"


আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চতম এবং নিম্নতম কর্মচারীদের মধ্যে বেতনের আকাশ-পাতাল তারতম্য দেখা যায়। ইসলামের স্বর্ণযুগে খলীফা এবং রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন কর্মচারীর জীবনমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলো না। বায়তুল মালের পাহারাদারের জীবনযাত্রার মান হযরত আবূ বকর, ওমর এবং 'আলী (রা)-এর জীবনযাত্রার মানের চেয়ে কম ছিলো না। আজকাল কম্যুনিস্টদের যা স্বপ্ন, তা-ই তেরশ বছর পূর্বে ইসলামী রাষ্ট্রে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছিলো।


সরল জীবনযাত্রা এবং কৃচ্ছ্রসাধন হযরত আবূ বকর, ওমর এবং 'আলী (রা)-এর জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো। নিষ্ঠাবান খলীফাগণ সরকারি কর্মচারীদের সামনে সরল জীবনযাত্রার আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। জনগণের অর্থের সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের ছিলো গভীর আন্তরিকতা। জনগণের অর্থে বড়লোক হওয়ার প্রবণতা তাঁদের ছিলো না। জীবনযাত্রার জন্য সর্বনিম্ন যা প্রয়োজন তাই খলীফাগণ বায়তুল মাল থেকে গ্রহণ করতেন। মাসিক ভাতা হিসেবে খলীফা যা পেতেন তা থেকে কিছুই সঞ্চয় করা যেত না।


ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত আবূ বকর (রা) ধনী লোক ছিলেন। তাঁর বর্ধিষ্ণু বস্ত্র ব্যবসায় ছিলো। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর হাতে ছিলো নগদ চল্লিশ হাজার দিরহাম। হিজরতের পূর্বেই তিনি প্রায় সমস্ত সঞ্চিত সম্পদ ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করে দেন।


তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে তাঁর সমস্ত সম্পদ তিনি জিহাদ ফান্ডে জমা দেন। রাসূল (স.) যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তাঁর পরিবারের জন্য কি রেখেছেন, তখন হযরত আবূ বকর (রা) দৃঢ় কণ্ঠে জানান, তাঁর পরিবারের জন্য আল্লাহ্ এবং রাসূলই যথেষ্ট।


জাহেলিয়াতের অন্ধকার হতে সত্যের আলোতে আগমনের ফলে আবূ বকর (রা.) হৃদয়মনে অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করেন। তমসাগ্রস্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্যে এবং ইসলামের সৌন্দর্য ও আলো বিকিরণের প্রয়াসে তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।


জীবিত থাকাকালে আবূ বকর (রা) সরল জীবন যাপন করতেন। মৃত্যুতেও তিনি সরলতার আদর্শ রেখে গেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) পিতার কাফনের জন্য তিন খণ্ড নতুন কাপড় কিনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরলোকযাত্রী পিতা আবূ বকর (রা) নির্দেশ দেন, তাঁর ব্যবহৃত দু'খণ্ড কাপড় ধৌত করে তা কাফনে ব্যবহার করতে হবে এবং মাত্র এক খণ্ড কিনতে হবে। এ নির্দেশ শুনে হযরত আয়েশা (রা) অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হন। শোকাপুত কন্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে হযরত আবূ বকর (রা) বলেন, মৃতের চেয়ে জীবিতদের জন্যেই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশি। মৃতকে যে কাপড় আচ্ছাদিত করে তা তো রক্ত এবং পুঁজই গ্রহণ করে। হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফতের স্থায়িত্বকাল ছিলো দু'বছর তিন মাস ১১ দিন। ঐ সময়ের মধ্যে ভাতা বাবদ খলীফা বায়তুল মাল থেকে গ্রহণ করেন ছ'হাজার দিরহাম। আনুমানিক পনেরশ টাকা। মৃত্যুশয্যায় খলীফা তাঁর একখণ্ড জমি বিক্রি করে সে টাকা বায়তুল মালে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ পালিত হয় ।


হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফত আমলে তাঁর সম্পদের মধ্যে তিনটি নতুন বিষয় সংযুক্ত হয় : ১. একটি উট, ২. আধা সরকারি একটি নুবিয়ান দাস এবং ৩. একখণ্ড বস্ত্র। খলীফা স্নেহময়ী কন্যা আয়েশা (রা)-কে ডেকে বলেন, “পানি বহনকারী উটটি এবং নুবিয়ান দাস আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। যে বস্ত্রখণ্ড আমার পরিধানে আছে তাও বায়তুল মাল থেকে নেওয়া। আমার মৃত্যুর পরই তা পরবর্তী খলীফা ওমর (রা)-কে হস্তান্তর করবে।”


এমনই ছিলো প্রাথমিক খলীফাদের আদর্শ এবং নীতি। তাঁদের জীবন ও শাসনপদ্ধতি মুসলিম সমাজের পরবর্তী শাসকদের আদর্শ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুঃখ ও আফসোসের বিষয় এই যে, বর্তমানে মুসলিম শাসকবর্গের মধ্যে দেখা যায় অর্থ সংগ্রহের তীব্র আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খাই তাদের দায়িত্বপূর্ণ পদের অনুপযোগী করে তোলে। ক্ষমতাসীন থাকাকালে কোন শাসক যদি কোন সম্পদ সংগ্রহ করেন তবে তা পরবর্তী শাসক কর্তৃক সরকারিভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়া উচিত। ইসলামের দৃষ্টিতে শাসক থাকা অবস্থায় সম্পদ সংগ্রহ নিষিদ্ধ। কারণ, ঊর্ধ্বতন কর্মচারী বা ক্ষমতাসীন গণপ্রতিনিধিগণ যদি দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তবে দুর্নীতির সয়লাবে সমগ্র শাসনযন্ত্রটিই বিকল হয়ে যায়। প্রাথমিক যুগের মহান খলীফাদের আদর্শ সামনে রেখে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের শাসকদের চিন্তাধারা গড়ে উঠুক এটাই মুসলিম জনগণের কাম্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url