হানাফী মাযহাব কেন এত জনপ্রিয়?
হানাফী মাযহাবের জনপ্রিয়তা
কেহ কেহ বর্ণনা করেন, সরকারী সাহায্যই হানাফী মাযহাবের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে হাজম বলেন, “দুইটি মাযহাবই প্রথম হইতে সরকারীসাহায্য ও সহানুভূতি লাভ করে। তন্মধ্যে একটি হল হানাফী মাযহাব । কাজী আবু ইউসুফ যখন প্রধান কাজীর পদ লাভ করেন, তখন হানাফী লোককে উচ্চ চাকুরীতে নিযুক্ত করেন।
ইমাম মালেকের মাযহাব দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। তাঁহার ছাত্র ইয়াহইয়া খলিফার বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁহার পরামর্শ ছাড়া খলিফা কাহাকেও কাজী পদে নিযুক্ত করিত না। তিনিও কেবল তাহার মাযহাবভুক্ত মানুষকে উক্ত পদে নিযুক্ত করিতেন।
১২০ হিজরীতে ইমাম আযম সাহেব এজতেহাদের মসনদে সমাসীন হন। কাজী ইউসুফ ১২০ হিজরীতে প্রধান কাজীর পদে নিযুক্ত হন। হারুনুর রশীদের শাসনকালে কাজী ইউসুফ সাহেবের ওয়াজ-নছিহত ও গৌরব বিকীর্ণ হইতে শুরু করে। হারুনুর রশীদ ১৩০ হিজরীতে খিলাফত লাভ করেন। আবু ইউসুফের প্রভাব ছাড়াই ইমাম আবু হানিফা সাহেবের আলো পৃথিবীকে আলোকিত করিয়াছিল । তাঁহার মাযহাব জনগণের নিকট খুব প্রিয় ছিল। তাঁহার অসংখ্য ছাত্র উচ্চ রাজপদ লাভ করিয়াছিলেন। কাজেই তাঁহার সফলতা লাভের জন্য অন্য কাহারো সাহায্য লওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না।
ইহা সত্য যে, কাজী আবু ইউসুফের প্রচেষ্টায় ইমাম আযমের মাসয়ালা সমাধিক প্রচারিত হইয়াছিল। কিন্তু হানাফী মাযহাবের প্রচার মূলতঃ কাজী সাহেবের চেষ্টা ও কর্মধারার উপর নির্ভরশীল ছিল না।
ইমাম রাজী ইমাম আবু হানিফা সাহেবের বিরোধী মহলের মানুষ হইলেও স্বীকার করিয়াছেন যে, হানাফী মাযহাব অত্যন্ত শক্তিশালী হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং ইহা অনেক প্রসিদ্ধিও লাভ করিয়াছে। মানুষের হৃদয়ে ইহা স্থান পাইয়াছে। তাহাছাড়া ইমাম আবু ইউসুফ ও মোহাম্মদের যখন খলিফা হারুনুর রশীদের দরবারে পদোন্নতি হইল, তখন হানাফী মাযহাবের শক্তি অধিক বাড়িয়াছিল।
ইমাম আবু ইউসুফের প্রভাব হারনুর রশীদ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইমাম আবু হানিফার প্রভাব-প্রতিপত্তি চিরস্মরণীয় রইল। অনেক ইমামই তাহাদের সময়ে খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। ইমাম আওজায়ী তাঁহার জীবিত কালে, এমন কি তৎপরেও সমগ্র শাম দেশে অদ্বিতীয় ইমাম হিসাবে সম্মান লাভ করিয়াছিলেন। তাহার পভাব পতিপত্তি সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে ইহার নাম-নিশানা পর্যন্ত নিশ্চিয় হইয়া গিয়াছিল। এই সকল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম আযম আবু হানিফা সাহেবের মাযহাবে এমন কোন আন্তর্নিহিত শক্তি সৌন্দর্য ছিল, যাহা অন্য কোন মাযহাবে ছিল না।
সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যে ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম মালেক,ইমাম শাফী ও আহমদ বিন হাম্বল সাহেবের ফেকাহ খ্যাতি লাভ করে। তাঁহাদের ফেকাহ শাস্ত্রের নিজস্ব গুণাগুণ এবং মৌলিকতা ইহাদের গুরুত্ব পরিবর্ধনে অবশই বিপুলভাবে সহায়ক ছিল। তদুপরি বাহিরের পারিপার্শ্বিকতাও ইহাদিগকে প্রভাবান্বিত করে ।
ইমাম মালেক ছিলেন মদিনাবাসী। ইহা নবুয়তের প্রাণকেন্দ্র ছিল। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়েও ইহা রাজধানী ছিল। কাজেই সাধারণত মদিনার জনগণ ইমামের প্রতি বিশেষ আন্তরিকতা ও বিশ্বাস-ভক্তি রাখত। তাঁহার বংশধরও একটি এলেমী খান্দান ছিল। তাহার দাদা মালেক বিন আবি আমর প্রসিদ্ধ সাহাবাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করেন। তাঁহার চাচা ছিলেন শায়খুল হাদীস। যখন ইমাম মালেক হাদীস ও ফেকাহতে বিশেষ জ্ঞান লাভ করিলেন, তখন তাঁহার পারিপার্শ্বিকতাও তাঁহার প্রভাব বিস্তারে বিপুলভাবে সাহায্য করিয়াছিল। তখন চারিদিকে তাঁহার সুনাম-গৌরব বিস্তৃতি লাভ করে ।
ইমাম শাফীর পারিপার্শ্বিকতা তাঁহার খ্যাতি বিস্তারে অধিকতর সাহায্য করিয়াছিল। তাঁহার জন্মস্থান ছিল মক্কা শরীফ। তিনি কোরাইশ বংশের মোতালেবের বংশধর। মাতৃপক্ষের দিক দিয়া তিনি হাশেমী ছিলেন। তাঁহার গোষ্ঠির সকলেই শ্রেষ্ঠ বীর ও চির সম্মানী ছিলেন। তাঁহার প্রপিতামহ বদরের যুদ্ধে হাশেমীদের পতাকাবাহী ছিলেন। তিনি সেই যুদ্ধে বন্দী হন। তারপর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি মক্কাতেই জন্মগ্রহণ করেন।
ইমাম আযম আবু হানিফা সাহেবের এই সকল অনুকূল পারিপার্শ্বিকতা ছিল না। কোরায়েশী বা হাশেমী হওয়া দূরের কথা, তিনি আরব দেশের অধিবাসীও ছিলেন না। মুসলিম সমাজে নেতৃস্থানীয় হওয়ার মত উপযুক্ত মানুষ তাঁহার বংশে জন্মগ্রহণ করে নাই। তাঁহার বাপ-দাদার পেশা ছিল ব্যবসা। তিনিও জীবনের এক বিরাট অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে অতিবাহিত করেন। তাঁহার জন্মভূমি কুফা নগর যদিও শিক্ষাকেন্দ্র বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিল তবু মক্কা ও মদিনার সাথে ইহার কোন তুলনা হইত না। কারণ অপ্রিয় পারিপার্শ্বিকতার দরুন বহুমুহাদ্দেছ ও রেওয়ায়েতকারী তাহার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এতটুকু বলা চলে যে, অনায়াসে জনগণ কর্তৃক সমাদৃত এবং জনগণকে প্রভাবান্বিত করিবার নিমিত্ত যাহা কিছু পরিবেষ্টনের আবশ্যক, সেই সমস্তের কোন কিছুই তাঁহার অনুকূলে ছিল না। এমতাবস্থায় তাঁহার ফেকাহ শাস্ত্র যে একদিন সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যে প্রচারিত ও বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল, ইহার মূলে নিশ্চয়ই কোন অন্তর্নিহিত শক্তি বিরাজ করিয়া থাকিবে । মানব মনের খোরাক নিশ্চয় ইহাতে ছিলী। বিশ্ব সভ্যতার সহিত তাঁহার ফেকাহ শাস্ত্রের যেরূপ গভীর সম্পর্ক ছিল অপর কোন ইমামের বেলায় তাহা প্রযোজ্য নহে । এইজন্যই যে সকল শহরে সভ্যতা অধিক বিস্তৃতি লাভ করে নাই, সেই সকল শহরে অন্যান্য ইমামের ফেকাহর বেশী প্রসার হইয়াছিল।
আল্লামা ইবনে খালদুন বলিয়াছেন যে, এই পারিপার্শ্বিকতার দরুনই ইমাম মালেকের মাযহাব পূর্বদেশে এবং উন্দুলুসে অধিকতর প্রসিদ্ধি অর্জন করিয়াছিল । সেখানে বুদ্ধরা সংখ্যায় বেশী ছিল এবং সেখানকার মানুষ তত উন্নতি লাভ করতে পারে নাই। এই কারণেই সেখানে ইমাম মালেকের মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাব তত প্রসার লাভ করে নাই ।
হানাফী ফেকাহতে ইমাম আযম ব্যতীত তাহার অন্যান্য প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মাসয়ালা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাহা সেই যুগের জন্য উন্নত আইন এবং অমূল্য বিধি-বিধানের সমষ্টি ছিল। তারপরও যখন হানাফী আলেমগণ তৎসঙ্গে অনেক কিছু যোগ করেন, তখন শত দিক দিয়া ইহা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছিল। প্রাথমিক অবস্থায় হানাফী ফেকাহ যতদূর পর্যন্ত উন্নতি "লাভ করিয়াছিল। তখন উহার চেয়ে অধিক উন্নতি কিছুতেই আশা করা যায় না। সেই বিরাট কিতাবে ইবাদত ছাড়া দেওয়ানী, ফৌজদারী, সাক্ষ্য প্রদান, উত্তরাধিকারত্ব প্রভৃতি অনেক আইন-কানুন স্থান লাভ করেছিল।
খলিফা হারুনুর রশীদের বিশাল সাম্রাজ্য তখন ভারতবর্ষ হতে এশিয়া ভূখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। সেই বিশাল সাম্রাজ্যও চলিত হানাফী আইন অনুযায়ী। তাঁহাদের সময়কার সব ঘটনা ও সমস্যার সমাধান হতে এই হানাফী মাযহাব অনুযায়ী ।