আবু হানিফা (রহ.) দলীল হিসাবে কাকে মানতেন?


ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ফিকহী উসূল

কুরআন হাদীস এবং ইজমার পর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হযরত আলী এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদকে (রা.) দলীল হিসাবে মানতেন । তাঁর মত ছিল, দুর্বল বা মুরসাল হাদীস কিয়াস হতে প্রাধান্য। কাজেই এর কোন একটির উপস্থিতিতে কিয়াস অনুযায়ী আমল করা যাবে না ।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) স্বয়ং তাঁর ফিকহী রায় এভাবে বর্ণনা করেন, প্রতিটি মাসয়ালার সমাধান কিতাবুল্লা হতে পেলে সেখান থেকেই আমি গ্রহণ করি। আর যদি সেখানে না পাই তবে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর ঐ সমস্ত হাদীস থেকে গ্রহণ করি, যেগুলো নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে নির্ভরযোগ্য রাবীগণ রেওয়ায়াত করেছেন। আর যদি এর সমাধান কোরআন এবং হাদীসে না পাই তবে সাহাবাদের থেকে যার মত ইচ্ছা গ্রহণ করি আর যার মত ইচ্ছা পরিত্যাগ করি। অতঃপর তাদের মত ছেড়ে অন্য কারও মত গ্রহণ করি না। আর যখন এটা ইব্রাহীম, শা'বী, ইবনে সীরিন, সায়ীদ বিন মুসাইয়্যেব এবং অন্যান্য মুজতাহিদ পর্যন্ত এসে পৌঁছে তখন তাদের মত আমার জন্যও ইজতিহাদ করার সুযোগ রয়েছে।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর উক্তিটি তাঁর ছাত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ ভিন্ন শব্দে নকল করেছেন। কাযী আবু ইউসুফের বর্ণনা হল, যখন নির্ভরযোগ্য রাবীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছে, তখন আমরা সেটি গ্রহণ করি। আর যখন সাহাবাদের মত আসে তখন আমরা আর বাইরে যাই না। আর যখন তাবেঈনদের রায় আসে তখন আমরাও স্বীয় রায় ব্যক্ত করি।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সবচেয়ে বড় বিরূপ মন্তব্যকারী খতীবে বাগদাদী তাঁর কিতাব 'তারিখে বাগদাদে' আব্দুল্লাহ বিন মুবারক থেকে তাঁর রায় নকল করেন,

যখন রাসূলুল্লাহ (স.)-এর হাদীস পাওয়া যায় তখন তা শিরধার্য। আর যখন সাহাবাদের মতামত পাওয়া যায়, তখন সেখান থেকে যে কোন একটি অবলম্বন করি। আর যখন তাবেঈনদের কোন রায় আসে তখন আমরাও তাদের মত ইজতিহাদ করি। অধিকন্তু খতীব বাগদাদী আল ফকীহ ওয়ালা মুতাফাক্কিহ নামক কিতাবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এ সম্পর্কিত কয়েকটি রায় উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বিশিষ্ট শাগরেদ যুফার বিন হুযাইল থেকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এ কথা বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ইলমে দ্বীনের কোন বিষয় সম্পর্কে কথা বলে এবং ধারণা করে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে প্রশ্ন করবেন না যে, দ্বীনের বিষয়ে তুমি কিভাবে ফতোয়া দিয়েছ, তবে তার নট্স যেন আত্মহত্যা এবং দিয়াত (রক্তপণ) দু'টিই সহজ করে দিয়েছে।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এ উক্তিটি খতীব বাগদাদী বর্ণনা করেন, যদি ইলমে দ্বীন নষ্ট হওয়ার কারণে আল্লাহর জিজ্ঞাসাবাদের ভয় না করতাম, তাহলে আমি কাউকে ফতোয়া দিতাম না। কেননা তার জন্য হবে আনন্দ আর আমার জন্য হবে বোঝা

ওকী বিন জাররাহ হতে খতীব বাগদাদী ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এ কথাটি বর্ণনা করেন, কোন কোন কিয়াস হতে মসজিদে মূত্র ত্যাগ করে দেয়া উত্তম।

এরপর লিখেন যে, ইয়াহয়া বিন সালেহকে ওকী বিন জাররাহ বলতেন, তুমি মাসআলা ও দ্বীনের বিষয়ে কিয়াস করা ছেড়ে দাও। কারণ আমি আবু হানিফাকে এরূপ বলতে শুনেছি।

খালেদ বিন সালমা আবু হানিফাকে বলতেন, কোন হাদীস না পেলে আমরা আপনার রায়ের মুখাপেক্ষী হই। আর যদি কোন হাদীস পেয়ে যাই তবে আপনার রায় দেয়ালের উপর নিক্ষেপ করি ।

যুফার বিন হুযাইল বলেন, হাদীস না পেলে আমরা কিয়াস অনুযায়ী আমল করি। হাদীস পেলে আমরা কিয়াস প্রত্যাখ্যান করে হাদীস গ্রহণ করি।

তদ্রূপ ওকী বিন জাররাহ বলেন, প্রয়োজনের ভিত্তিতে আৰু হানিফাকে যে কোন কথা বলেছেন, আমরা তার সমর্থনে হাদীস রেওয়ায়াত করি

ফিকহর যে সমস্ত মাসয়ালা কিয়াসের বিপরীত হয়, সেগুলোকে ইস্তিহসান বলা হয়। এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) খুবই সতর্কতা অবলম্বন এবং চিন্তা ফিকিরের সাথে কাজ করতেন। এ সম্পর্কে তাঁর বিশিষ্ট শাগরেদ ইমাম আবু ইউসুফ থেকে খতীব বাগদাদী এ কথাটি উল্লেখ করেছেন, ফিকহ সম্পর্কিত কোন মাসয়ালা বর্ণনা করার পূর্বে এক বৎসর পর্যন্ত তিনি চিন্তা ফিকির করতেন। এ সময়ে তাঁর কোন শাগরেদের নিকট তা প্রকাশ করতেন না। এক বৎসর পর সেটাকে সুদৃঢ় করে তাদের সামনে পেশ করতেন। আর যখন ইস্তিহসান সম্পর্কে কথা বলতেন তখন গভীর চিন্তা এবং বিবেচনার পর নিশ্চিন্ত হলেই কিছু বলতেন, অন্যথায় বলতেন না।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে খতীব বাগদাদীর এসব উদ্ধৃতি শত্রু স্বীকৃত গুণ এর পর্যায়ে। এতে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ফিকহী পারদর্শীতা স্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে।

আবু হানিফার সকল শিষ্য এ বিষয়ে একমত যে, হানাফী মাযহাবে কিয়াস অপেক্ষা দুর্বল হাদীস উত্তম এবং অগ্রগণ্য।

ইমাম আওযায়ী (রহ.) সিরিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি একজন উল্লেখযোগ্য ও প্রসিদ্ধ ইমাম ও একটি ভিন্ন মাযহাবের প্রবতর্ক ছিলেন।

একবার মক্কা মুকাররমায় ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। প্রসঙ্গক্রমে রফে ইয়াদাইন অর্থাৎ রুকুতে যাবার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় হাত উঠানোর মাসয়ালাটি নিয়ে তারা আলোচনা করলেন।

ইমাম আওযায়ী (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ইরাকবাসীরা! আপনাদের কী হল আপনারা রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় হাত উঠান না।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন, এ সম্পর্কে কোন শক্তিশালী হাদদীস নেই । এতে ইমাম আওযায়ী (রহ.) বললেন, কি করে আপনারা বলেছেন যে, এ সম্পর্কিত কোন গ্রহণযোগ্য হাদীস নেই। অথচ আমার নিকট ইমাম যুহরী (রহ.) সালেমের বরাদ দিয়ে তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে রেওয়ায়াত করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (স.) নামায শুরু করার সময় রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় হাত উঠাতেন।

তাঁর উদ্দেশ্য এটা বুঝানো ছিল যে, এ হাদীসের রাবী প্রত্যেকেই নির্ভরযোগ্য। কাজেই রফে ইয়াদাইনের হাদীস নির্ভরযোগ্য সনদ দ্বারা প্রমাণিত। এর উত্তরে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন, আমার নিকট হাম্মাদ ইব্রাহীম হতে, তিনি আলকামা হতে, তিনি ইবনে মাসউদ (রা.) হতে রেওয়ায়াত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স.) নামায শুরু করার সময় ব্যতীত অন্য সময়ে রাফয়ে ইয়াদায়ন করতেন না।

ইমাম আওযায়ী (রহ.) এ কথা শুনে বলতে লাগলেন, সুবহানাল্লাহ! আমি যুহরী হতে সালেমের বরাদ দিয়ে ইবনে উমরের রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছি আর আপনি হাম্মাদ আমাকে ইব্রাহীম হতে রেওয়ায়াত করেছে বলেছেন ।

ইমাম আওযায়ী (রহ.) বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর রেওয়াতের তুলনায় তার রেওয়ায়াতে রাবীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণে তার হাদীসটির সনদ আলী বা উন্নত। কারণ তাঁর রেওয়ায়াতকৃত হাদীসের সনদে তাঁর মধ্যে এবং হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী ইবনে উমর (রা.)-এর মধ্যে মাত্র দু'জন রাবী রয়েছেন।

পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বর্ণিত হাদীসের সনদে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এবং হাদীস রেওয়ায়াতকারী সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মধ্যে তিনজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। কাজেই তাঁর বর্ণিত হাদীসটির সনদ আলী তাই সেটি পাধান্য পাওয়ার দাবীদার।

এর উত্তরে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন, হাম্মাদ ফিকহ সম্পর্কে যুহরী হতে বেশি জ্ঞানী। ইব্রাহীম ফিকহ সম্পর্কে সালেম হতে বেশি জ্ঞানী। ফিকহর ব্যাপারে ইবনে উমর হতে আলকামা কম জ্ঞানী যদিও তিনি সাহাবী হবার মর্যাদা লাভ করেছেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ তো নিজেই নিজের তুলনা। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এ উত্তর শুনে ইমাম আওয়ায়ী (রহ.) খামুশ হয়ে গেলেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url