ক্রয়-বিক্রয়ে হানাফী ফিকহের মূলনীতি।

ক্রয়-বিক্রয়ে হানাফী ফিকহের মূলনীতি

ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহ.) স্বীয় সংগী-সাথী ও শিষ্যদের সাহচর্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিধানে যে সব শাখা-প্রশাখা লিপিবদ্ধ করেছেন তা ৪টি মৌলনীতির উপর ভিত্তিশীল। যেমন :

১. ক্রয়-বিক্রয়ের প্রথম উসূল হলো, যে বস্তু বিনিময় করা হবে তা অবশ্যই জ্ঞাত হওয়া জরুরী। কেননা বস্তুর অজ্ঞতায় সংঘাত, মনোমালিন্য ও বিবাদ অবশ্যভারী হতে পারে। এ কারণে 'বাইয়ে মুরাবাহা', ভাওলিয়া ও ইশরাক-এর ক্ষেত্রে মূল মূল্য জানা থাকতে হবে। বায়ে মুরাবাহার ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণ নির্দিষ্ট হওয়া চাই। বাইয়ে সালাম-এ মূলধন (راس المال) এবং 'মুসাল্লাম

ফীহ' নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। কেননা এসব ক্ষেত্রে পরিমাণের অজ্ঞতা অধিকাংশ সময় ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করে। ইসলামী শরী'আত ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয় হস্তান্তরের ভিত্তি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত হওয়া জরুরী, যাতে বিবাদ সৃষ্টি না হয়। এমনিভাবে সে শব্দাবলীও জানা অত্যন্ত জরুরী যে সব দ্বারা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে বিবাদ হতে পারে এমন বিষয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। এবং এ সব বর্জন না করলে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়। পরস্পর আচার-ব্যবহার নষ্ট হয়ে পড়ে এবং কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছা বড় কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং এসব ফিনার দ্বার রুদ্ধ করার জন্য এ সব বিষয় ভালভাবে জানতে হবে।

২. দ্বিতীয় মূলনীতি হলো সুদ এবং সন্দেহযুক্ত সুদ বর্জন করা। ক্রয়-বিক্রয়ের সকল ইসলামী বিধানের মধ্যে এটি একটি বুনিয়াদী উসুলের মর্যাদা রাখে। কেননা সকল প্রকার সুদ ইসলামী বিধানশাস্ত্রে নিকৃষ্টতম ও জঘন্য মনে করা হয়ে থাকে। কুরআন ও সুন্নাহে এ বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নবী করীম (স.) থেকে একখানা হাদীস বর্ণিত হয়েছে,

তিনি বলেছেনঃ
کل درهـم واحـد مـن الربا أشد من ثلاث وثلاثـيـن زيـنـة-
بزنيها الرجل ومـن نـت لـحـمه من حرام فالنار أولى به-
এক দিরহাম পরিমাণ সুদ তেত্রিশবার ব্যবিচারের চেয়েও জঘন্য। আর যে মাংস হারাম দ্বারা বর্ধিত হয়, তা জাহান্নামের উপযোগী।

ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহ.) সুদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। এমন কি তিনি 'দারুল হরব'-এর মুসলিম এবং হরবী কাফিরের মধ্যে সুদের অনুমতি দেন নি। সুদ হারামের ব্যাপারে যখন এমন কঠোরতা লক্ষ্য করা যায়, তখন সে ব্যাপারে সুদের সম্পর্কের সন্দেহ থাকলে তা কিভাবে জায়িয হবে? বরং তা ফাসিক বলেই বিবেচিত হবে। যাতে সুদ মূলোৎপাটিত হয় এবং ধন-সম্পদ অবৈধ পন্থায় ভক্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অধিকন্তু ব্যবসায়িক বিষয়ের মূল ভিত্তিই হলো সমতা, মাল-সম্পদের মধ্যে পরিমাণগত সমতা- যাকে ক্রেতা-বিক্রিতা এবং ইসলামী শরী'আত সত্যিকার অর্থেই সমতার বিষয় বলে মান্য করে। কিন্তু স্পষ্ট রিবা সুদ শরী'আত প্রণেতা (আ.)-এর দৃষ্টিতে এক প্রকারের অবৈধ বর্ধিতাংশ। সুতরাং যে বিষয়টি সুদের সাথে সম্পর্কিত হবে, তা ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে আদৌ বিবেচ্য হতে পারে না।

৩. তৃতীয় মূলনীতি হলো এই যে, ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যেখানে নস্ পাওয়া যাবে না বা থাকবে না, সেক্ষেত্রে উরফ-কেই সঠিক বলে মনে করা হবে। যে বিষয়টি উরফ-এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে, তাই গ্রহণ করা হবে এবং যে বিষয়টি উরফ-এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে না, তা পরিত্যায্য বলে বিবেচিত হবে। যেমন “মুরাবাহা' পদ্ধতিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য উদ্ধৃতির সময় সে সব বিষয়ও তাতে শামিল বলে গণ্য করা হবে, যা সাধারণত মূল্যের মধ্যে গণ্য করা হয়ে থাকে এবং যা প্রচলিত উরফ মতে তাতে শামিল বলে গণ্য করা হবে না, তাকে মূল্যের মধ্যে গণ্য করাও দুরস্ত হবে না। এমনিভাবে কাপড়ের মূল্য বলার ক্ষেত্রে প্রচলিত উরফ মতে দর্জী ও রংকর (রঞ্জক)-এর পারিশ্রমিকও তাতে শামিল করতে হবে। ইমাম কাসানী (রহ.) লিখেন।
“ধোপা, রঞ্জ, ভাঁজাইকার, দর্জী, দালাল, প্রবৃতির পারিশ্রমিক এবং ভাড়া মূলধনের সাথে যোগ করাতে কোন বাধা নেই। এ সবকে যোগ করে 'মুরাবাহা' এবং ‘তাওলিয়া' পদ্ধতিতে বিক্রয় করা হবে। কেননা ব্যবসায়ী সাধারণত এ সবকে মালের ক্রয় মূল্যের সাথে যোগ দিয়ে থাকে এবং মুসলিমদের প্রচলিত রীতি-নীতি (উরফ) নবী করীম (স.)-এর হাদীসের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে ।

যেমন বর্ণিত হয়েছে :
ماراه المسلمون حسنا فهـوعـنـد اللله حسـن
মুসলিমদের নিকট যে বিষয়টি পছন্দনীয় হবে, তা আল্লাহ্র নিকটও পসন্দনীয়।

অবশ্যই বিক্রয়কালে এ কথা বলা উচিত না যে, আমি অমুক বস্তু এত দামে ক্রয় করেছি বরং বলতে হবে আমার এ মূল্য পড়েছে। কেননা প্রথম উক্তিটি মিথ্যা এবং দ্বিতীয় উক্তিটি সত্য। পশুপালের রাখাল ও পশু চিকিৎসকের পারিশ্রমিক এবং নিজের ব্যক্তিগত খরচাদি মূলধনের সাথে শামিল করা যাবে না। 'মুরাবাহা' ও 'তাওলিয়া' পদ্ধতিতে বিক্রয় সে মূল্য মোতাবিক সম্পন্ন করা উচিত যা বিক্রয়কালে আদায় করা হয়েছে, তা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে সব কিছুই উন্নফ ও দেশে রেওয়াজের ভিত্তিতেই করা হবে।

৪. চতুর্থ মৌলনীতি হলো এই যে, এ সকল প্রকার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে আমানতদারী হলো ভিত্তিমূল। যখন অপরাপর ইসলামী মু'আমিলাত তথা সামাজিক কার্যক্রমে আমানতদারী মূলনীতির দিক থেকে 'মধ্যমণি' হিসেবে গণ্য। কেননা মানুষের পারস্পরিক মু'আমিলাতে এ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। তখন 'মুরাবাহা ও তাওলিয়া' এবং ক্রয়-বিক্রয়ের অপরাপর পদ্ধতির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে বলে ফিকহী মূলনীতি রয়েছে। কেননা ক্রেতা এ ক্ষেত্রে বিক্রেতার উদ্ধৃত মূল্যের উপরই বিশ্বাস করে, এ ক্ষেত্রে সে কোনরূপ সাক্ষ্য-প্রমাণ বা কসমের ধার ধারে না। সুতরাং তাকে খিয়ানত ও তোহমত থেকে বাঁচানো অপরিহার্য। আল্লামা কাসানী (রহ.) লিখেছেন। যথা সম্ভব এ থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব।”

মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন :
بايها الذين امنوا لاتـخـونـوا الله والرسـول وتـخـونـوا
امنتـكـم وانـتـم تـعـلـمـون .
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের খেয়ানত করো না এবং তোমাদের পারস্পরিক লেনদেনেও খেয়ানত করো না। জেনেশুনে এমনটি করা জায়িয নয়। (সূরা আনফাল : ২৭)

রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন :
من غش فليس منا .
ধোঁকাবাজ আমাদের দলভুক্ত নয়।

এ মূলনীতি ব্যবসায়ের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিদ্যমান, যা ইমাম আযম আবু হানীফা (রহ.) থেকে বির্ণত হয়েছে। উপরন্তু এ মূলনীতি তাঁর দীনি অনুভূতি ও মূল্যবোধের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে একীভূত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। অধিকন্তু ব্যবসায়ের অপরাপর সাধারণ নীতিমালার এবং ব্যবসায়ের তাঁর পারদর্শিতা ও অভিজ্ঞতার সাথেও সামঞ্জস্যশীল। এ বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারা সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url