ইমাম আবুহানিফা হাদীসের মোকাবেলায় কেয়াছের প্রতি কতটুকু গুরুত্ব প্রদান করিতেন?


হাদীস ও কেয়াস

ইমাম আবুহানিফা সাহেবের বর্ণনায় ইহা প্রমাণিত হইয়াছে যে,হাদীসের মোকাবেলায় তিনি কেয়াছের প্রতি মোটেই গুরুত্ব প্রদান করিতেন না।
ইমাম মোহাম্মদের অভিযোগ এই যে, কোন ব্যক্তি যদি রমযান মাসে ভুলে কিছু পানাহার করিয়া ফেলে, তবু রোজা বিনষ্ট হইবে না এবং উহার কাযাও করিতে হইবে না।

হ্যাঁ, ইহা সত্য যে, হাদীসের প্রমাণও দলীলের ব্যাপারে ইমাম আযম অত্যন্ত শক্ত ছিলেন। হাদীসের শর্তাবলী না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তাহা গ্রহণ করতেন না। আর শর্তাবলী অনুযায়ী হাদীস প্রমাণিত হইলে কেয়াছের প্রতি তিনি কোনই গুরুত্ব দিতেন না।

ইমাম আবু হানিফা হাদীসের চেয়ে কেয়াছ ও ফেকাহর প্রতি বেশী গুরুত্ব দেন নাই। কিন্তু তাঁহার সময় পর্যন্ত কেয়াছ শব্দটি খুব প্রশস্ত অর্থে ব্যবহৃত হইত এবং ইহাতে সন্দেহ নাই যে, কেয়াছ শব্দের এই প্রশস্ততার জন্যই ইমাম আযম কেয়াছকে হাদীস নির্বাচনকারী হিসাবে গ্রহণ করেন।

মাসায়ালা ও আহকামে শরীয়তের দুনিয়ায় প্রথম হইতেই দুইটি দল গড়িয়া উঠিয়াছিল। এক দলের বিশ্বাস ছিল যে, শরীয়তের বিধি-বিধান কোন মঙ্গল ও জ্ঞান-বুদ্ধির সীমানায় সীমাবদ্ধ নহে। অন্য দলের বিশ্বাস এই যে, শরীয়তের সমূহ হুকুম নিষেধগুলির উপর নির্ভরশীলী। তন্মধ্যে কতকগুলির ভালো অভ্যন্ত সুস্পষ্ট।

এই সকল বিভিন্ন মতভেদের হাদীস রেওয়ায়েতের বিভিন্ন ধারায় প্রচলিত রহিয়াছে। এমনও অনেক রহিয়াছেন যে, যখনই তাঁহারা কোন হাদীস স্মরণ করেন, তখন তাঁহারা এতটুকু লক্ষ্য রাখেন যে, ইহার রেওয়ায়েতকারী বিশ্বাসযোগ্য কিনা। তাহাদের ধারণা মতে, তাহা যদি গ্রহণযোগ্য ও প্রমাণ সাপেক্ষ হইয়া থাকে, তখন তাহারা অন্য কোন কিছুর জন্য তত মাথা ঘামান না এবং খুব সহজে হাদীস গ্রহণ করিয়া থাকেন ।

অন্য যে দল জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেচনার উপর বেশী গুরুত্ব দেন তাঁহারা দেখেন যে, মাসয়ালা হাদীসের আকীদা অনুযায়ী টিকে কি-না এবং রেওয়ায়েতের ব্যাপারে তাঁহার কতখানি মর্যাদা রহিয়াছে, তাহা শব্দে শব্দে রেওয়ায়েত করা। হইয়াছে, নাকি ভাব অনুযায়ী রেওয়ায়েত করা হইয়াছে, কাহাকে লক্ষ্য করিয়া তাহা বর্ণনা করা হইয়াছে, তখন পারিপার্শ্বিকতা কিরূপ ছিল। আসল কথা এই জাতীয় কার্যকরণ ও ভিত্তি-ভূমির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হইয়া থাকে এবং এই সমস্ত তথ্য হইতে মূল সত্য প্রকাশিত হয়।

হযরত আবু হোরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ (স.) হইতে হাদীস রেওয়ায়েত করিয়াছেন, “অগ্নি যে বস্তুকে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে, তাহা ব্যবহার করিলে অজু নষ্ট হইয়া যাইবে।” এইজন্য কোন কোন মুজতাহিদের মত এই যে, গোস্ত খাইলেও অজু করিতে হইবে ।

যখন আবু হোরায়রা এই হাদীস বলিতেছিলেন, তখন আবদুল্লাহ বিন আব্বাস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “এই হাদীসের ভিত্তিতে তো গরম পানি ব্যবহার করিলে নূতন অজু করিতে হইবে!” আবু হোরায়রা বললেন, “হে ভাই! রাসূলুল্লাহ (স.) হইতে যখন কোন রেওয়ায়েত শুনিতে পান, তখন উহার উপর কোন দৃষ্টান্ত দিবেন না।” ইহার পরও আবদুল্লাহ বিন আব্বাস নিজের অভিমতের উপর ঠিক রইলেন ।

ইবনে ওমর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত-আত্মীয় ক্রন্দন করিলে মৃত ব্যক্তি শাস্তির ভাগী হইবে । বিবি আয়েশা (রা.) উহার প্রতিবাদ করিয়াছেন । সাহাবাদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটিত হইয়াছে।ইমাম আযমের এইরূপ মত ছিল। মানুষগণ তাঁহার এই মতবাদকে কেয়াছ নামে আখ্যা প্রদান করিয়াছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের কিতাব এই বিষয় সম্বন্ধে যথেষ্ট। এখানে এতটুকু বলা যথেষ্ট যে, ইমাম গাজ্জালী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখমহাজ্ঞানী ইসলামের আলেমদের একই অভিমত ছিল। ইমাম আযম হাদীস সংশোধন ব্যাপারে এই নিয়মকে বিশেষ প্রয়োজনে বহাল রাখিয়া দিয়াছেন। এমন দুইটি হাদীস যদি রেওয়ায়েত হিসেবে সমপর্যায়ভুক্ত হয়, তন্মধ্যে সেই হাদীসটির প্রতি বেশী গুরুত্ব দিতে হবে যাহা উল্লিখিত উছুল অনুযায়ী টিকে।

ইমাম আযমের সময় শুধু এই উছুলের সাথে খাপ না খাওয়ায় কোন কোন হাদীসকে গ্রহণ করিতে দ্বিধাবোধ করিয়াছেন।

হাদীস বাচাই বা যাচাই কোনটাই সহজ কাজ নহে ইহা পার্থিব ব্যাপার নহে। পৃথিবী ছাড়াও অন্য কোন কিছুর সাথে মুহাদ্দেছীনের যোগাযোগ থাকে । উহাকে এক প্রকার এলহাম বলে। ইমাম বোখারীর শিক্ষক আলী ইবনে মদীনী অত্যন্ত প্রসিদ্ধ মুহাদ্দেছ ছিলেন। তিনি বলিয়াছেন, ইহা এক রকম এলহাম। বাহিরে কোনরকম মানুষ যদি ইহার দলিল চায়, তবে তাহা পেশ করা সম্ভবপর হইবে না ।

মুহাদ্দেছ আৰু হাতেমের নিকট মানুষ কয়েকটি হাদীস জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি তন্মধ্যে কতককে প্রচলিত কথা, কতককে বাতিল, কতককে অগ্রাহ্য এবং কতককে সহীহ বললেন।

প্রশ্নকারী বললেন, “আপনি কিভাবে তাহা বুঝতে পারলেন? এই সকল হাদীসের রাবী কি এই সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলিয়াছেন?” আবু হাতেম বললেন, “না বরং আমি এইভাবেই বুঝিয়া লই।” প্রশ্নকারী বলেলেন, "তবে কি আপনি গায়েবের খবর জানেন বলিয়া দাবী করিয়া থাকেন?

আবু হাতেম বললেন, আপনি অন্যান্য মুহাদ্দেছীনদের নিকট এই স জিজ্ঞাসা করুন । যদি তাঁহারা আমার সাথে একমত হন, তবে বুঝিতে হইবে যে, আমি অসঙ্গত কিছুই বলি নাই।'

সেই প্রশ্নকারী আবুজর (রা.)-এর নিকট গিয়ে সেই সকল হাদীস জিজ্ঞাসা করেলেন। তিনি সম্পূর্ণ আবুহাতেমের ন্যায় মত প্রকাশ করেলেন তখন প্রশ্নকারী চুপ হইয়া গেলেন।

মুহাদ্দিছগণের কেকেহ বলিয়াছেন, ইহা একটি ভাবধারা। তাহা হাদীসেরইমামের গায়ে ঢালিয়া দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ব্যক্তি তাহা প্রবাহিত করিতে পারে না।
মুহাদ্দিছগণের এই সকল দাবী সম্পূর্ণ সত্য। ইহা ঠিক যে, রেওয়ায়েতকারীদের ভিতর এমনই একটা প্রেরণা জাগে, যাহা দ্বারা তাঁহারা নিজেরাই বুঝিতে পারেন যে, ইহা রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বাণী কি না শরীয়তের আহকাম, মাসয়ালা, রহস্য ও মংগলের অনুকরণের ফলে তাঁহাদের হৃদয়ে এমন। একটি প্রেরণা আসে যে, তাহাতে তাঁহারা রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বাণী কি না, তাহা স্বচ্ছন্দে বুঝিতে পারেন। কিন্তু এই সকল রহস্য এবং মংগলের অনুকরণ অনুসরণ মুহাদ্দিছদের পক্ষে ফরজ নহে। ইহা মুজতাহেদের জন্য সীমাবদ্ধ। এই সকলের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করিয়াই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কতক হাদীসকে গ্রহণ করিয়াছেন আবার কতক হাদীসের বিরোধিতা করিয়াছেন।

হাদীস গ্রহণ ও রদবদল সম্পর্কে যাহা কিছু জ্ঞান-গরিমা ও বুদ্ধিমত্তার দরকার, ইমাম আযম সাহেবের মধ্যে সেই সমস্তের কোন কিছুরই অভাব ছিল। না। তবে ইহা সত্য যে, ইহা অতি সূক্ষ্ম কর্তব্য ও গুরু দায়িত্বপূর্ণ কাজ। খুব বড় আলেম, মুজতাহেদ, মুহাদ্দেছ, ফেকাহবিদ এবং খোদাতাআলার সাহায্য পুষ্ট লোক ছাড়া অন্য কাহারো এই কার্যের ভার গ্রহণ শোভা পায় না এবং ইমাম আবু হানিফা সাহেব এই সম্পৰ্কীয় সর্বগুণে ভূসিত ছিলেন।

হাদীসসমূহের স্তরসমূহ নির্ণয় এবং সকলের সম্মুখে উহাদের প্রভেদ স্পষ্ট ও প্রকট করিয়া দেওয়ায় ইমাম আযম বর্ণনাতীত জ্ঞান-গরিমা, সূক্ষ্ম দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করিয়াছেন। শরীয়তের হুকুম-আহকাম এবং মাসয়ালা সম্বন্ধে বর্ণনা করিতে যাইয়া তিনি কোরআন শরীফকে সর্বশ্রেষ্ঠ আধার বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছেন তাঁহার নির্বাচন যে অকাট্য ও ধ্রুব, ইহা সন্দেহাতীত। কোরআনের পরেই হাদীসের স্থান। কোরআন ও হাদীসের মৌলিকতার দিক দিয়া অনেক বেশী পার্থক্য নাই। হযরত জিব্রাইল (আ.) মারফত কোরআন অবতীর্ণ হয় এবং তিনি স্বয়ং তাহা পড়িয়া রাসূলুল্লাহ (স.)-কে শুনান। হাদীসও ওহী বৈ কিছুই নহে। তবে তাহা জিব্রাইল (আ.) রাসূলুল্লাহ (স.)-কে পড়িয়া শুনান নাই। এইজন্য কোরআনকে ওহী মাতলু এবং হাদীসকে ওহী গায়ের মাতল বলে। প্রমাণের দিক দিয়াই স্তরবিন্যাস ও মতভেদ রহিয়াছে। কোন হাদীস যদি অকাট্য প্রমাণের দিক দিয়া কোরআনের মত প্রমাণিত হয়, তবে আদেশ নির্ধারণে তাহা কোরআনের সমকক্ষ। কিন্তু প্রমাণের দিক দিয়া হাদীসের অনেক স্তর রহিয়াছে। কাজেই আদেশ নির্ধারণে এই সমস্ত স্তরবিন্যাসের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। সহীহ, হুছন,. জঈফ, মশহুর, আজীজ, গরীব প্রভৃতি হাদীসের যাহা কিছু স্তর রহিয়াছে, ইহাদের স্তর বিভিন্ন হইলেও ইহাদের প্রত্যেকটিরই হুকুম নির্ধারণের ক্ষমতা রহিয়াছে। মুহাদ্দেছীন জঈফ হাদীসের প্রতি কোন গুরুত্বারোপ করেন নাই । তাছাড়া তাঁহারা অন্যান্য সবগুলিতেই প্রায় কাছাকাছি গুরুত্ব প্রদান করিয়া থাকেন। মুহাদ্দেছীনের পক্ষে এই সকলের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কোন দরকার ছিল না। কারণ আদেশ নির্বাচন ও মাসয়ালা শ্রেণীবিভাগ তাঁহাদের জন্য ফরজ নহে। ইমাম আযম ফেকাহ শাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপনকারী ছিলেন। এই জন্য তাঁহার পক্ষে অধিক সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও শ্রেণী বিভাগের প্রভেদ প্রদর্শন আবশ্যকীয় ছিল। প্রকারভেদে তিনি হাদীসকে মুতাওয়াতের, মশহুর ও আহাদ-এই তিন ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url