ফিকহ্ এর চার ইমাম।

ফিকহ্ এর চার ইমাম


পূর্বেই বলা হয়েছে যে, নবী করীম (স.)-এর জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বীনি আহকামের উৎস ছিল অহী এবং নবী করীম (স.)-এর কাজ ও উক্তি। অতঃপর সাহাবা ও তাবেয়ীগণের যুগে ইলমের বাহকগণ মিশর, ইরাক প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদের উসূলে ফিকহ্ এবং ফতোয়ার ক্ষেত্রে পরস্পরের কিছুটা পার্থক্য ছিল ।

হেজাযের আলেমগণ হাদীসের সনদ ও মতন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ইমাম মালেক (রহ.) 'মুয়াত্তা মালেক’ নামক হাদীসের কিতাবখানা ফিকহ্ শাস্ত্রের পূর্ণ উসূল অনুযায়ী রচনা করেন।

অপরদিকে ইরাকের আলেমগণ হাদীসের বর্ণনার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। এমনকি তারা কোন মাসআলার ব্যাপারে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে قال رسول الله صلى الله عليه وسلم "রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন" না বলে নিজের দিকে সম্বন্ধ করে বলতেন। যাতে রাসূলুল্লাহ (স.) যে বিষয় বলেন নাই এমন কোন বিষয়ের সম্বন্ধ তার প্রতি না হয়। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাদের একান্ত সতর্কতার পরিচয় তারা এভাবেই দেখিয়েছেন। ইমাে আযম আবু হানীফা (রহ.) ছিলেন এদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি আপন শিষ্যদেরকে নিয়ে উসূলে ফিকহ (ফিকহবিধি) এবং ফিকহ শাস্ত্রকে সাজিয়েছেন।

উপরোক্ত ইমামদ্বয়ের পরবর্তী স্থানে হেজাযী আলেমগণের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্ৰীছ শাফী (রহ.) শীর্ষস্থানের ফিকহবিদ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। যিনি মক্কা-মদীনার মুহাদ্দিছগণ থেকে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেন। আর ইমাম আযম আবু হানীফা (রহ.)-এর শীষ্যগণের নিকট বিশেষ করে ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর নিকট ইলমে ফিকহ হাসিল করেন। মোটকথা তিনি উভয় কেন্দ্র থেকে ফিকহ ও হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করতঃ উভয় ধারার সমন্বয়ে একজন স্বতন্ত্র ফিকহবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন।

ইমাম শাফী (রহ.)-এর পর ফিকহ শাস্ত্রের ময়দানে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর আগমন হয়। তিনিও একজন স্বতন্ত্র ফিকহবিদ হিসেবে আগমন করেন তবে তার ফিকহর যোগসূত্র ছিল হেজাযী মুহাদ্দিছগণের ইলমী ধারার সাথে। এজন্যই তাঁর মাযহাবের অধিকতর সম্পর্ক ছিল হাদীসের বাহ্যিক শব্দের সাথে। তবে তিনি ইমাম দাউদ জাহেরীর মত চিন্তা ও রায়কে একেবারে বাদ দিয়ে দেননি।

উপরে উল্লেখিত চার ইমামের ফিকহী মাযহাব প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে প্রত্যেক এলাকার কোন ইমামের ফতোয়া ও দ্বীনি মাসআলার ক্ষেত্রে স্থানীয় মুফতীগণের অনুকরণ করতেন। এমনকি কোন ইমামের এক এলাকার ফতোয়া অন্য এলাকায়ও চলত।

মোটকথা, চার ইমামের ফিকহী মাযহাব প্রচলিত হওয়ার পূর্বে একাধিক ফকীহ এর ফিকহ ও ফতোয়া প্রচলিত ছিল। যাঁদের ফিকহ ও ফতোয়া সে সময় প্রচলিত ছিল তাঁরা হচ্ছেন, ইমাম সুফিয়ান ছাউরী (রহ.), ইমাম হাসান বসরী (রহ.), ইমাম আউযায়ী (রহ.) প্রমুখ। এঁদের মাযহাব তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এরপর তা আস্তে আস্তে লোপ পেয়ে যায়। তবে ইমাম দাউদ জাহেরীর মাযহাব ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। তারপর এ মাযহাব শেষ হয়ে যায়। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খালদুনের বর্ণনা অনুসারেও উক্ত মাযহাব ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। উক্ত মাযহাবের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে,এতে শুধু হাদীসের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা যে মর্মার্থ বুঝা যেত তাই গ্রহণ করা হত, কেয়াস বা যুক্তির সাহায্য ও সহযোগিতা গ্রহণ করা হত না।

উপরোক্ত ইমামদের মাযহাবসমূহ ছাড়া ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, ইবনে জারীর, সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না, লায়েছ ইবনে সাদ প্রমুখ ইমামগণের মাযহাবও প্রচলিত ছিল। কিন্তু এদের মাযহাবও এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রচলিত থাকার পর খতম হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের দ্বীনি আহকাম এবং মাসায়েল ও ফতোয়া সংক্রান্ত বিষয় চার ইমামের চার মাযহাবের সাথেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। যেহেতু কোন এক মাসআলার ব্যাপারে একই মাযহাবের অনুসরণ করা যেতে পারে তাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সর্ব সাধারণ মুসলমানদেরকে এ চার মাযহাবের যে কোন একটি মাযহাব অবলম্বন করে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। এরূপ করার কারণ হল, যাতে ব্যক্তি স্বার্থে কেউ কোন মাসআলা গ্রহণ করতে এবং অন্য মাসআলা ছেড়ে দিতে না পারে। অন্যথায় এক মাযহাবের অনুসারী এ মাযহাবের কোন মাসআলা তার স্বার্থ বিরোধী হলে অন্য মাযহাবের মাসআলা গ্রহণ করে নিবে এবং এ মাযহাব ছেড়ে দিবে। এটা দ্বীনের লক্ষ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাঁদের মাযহাবের অনুসরণ করার অর্থ প্রকৃতপক্ষে কোরআন ও হাদীসরই অনুসরণ করা। কারণ সাধারণ লোকের পক্ষে সরাসরি কোরআন ও হাদীস হতে মাসয়ালা বের করা এবং সমস্ত কোরআন এবং হাদীসের সাথে সাম স্য বিধান রক্ষা করে আমল করা সম্ভব নয়। তাই সাধারণ লোকের জন্য বর্ণিত চার মাযহাবের যে কোন এক মাযহাব অবলম্বন করা এবং সে অনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালনা করা একান্ত জরুরী।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url