ইমামে আযম ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বৈশিষ্ট্য


ইমাম আযম হযরত আবু হানিফা (রহ.)-এর বৈশিষ্ট্য

ইমামুশ্বারীয়াত হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামী দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম, জ্ঞানী, শরীয়ত বিশারদ, যুক্তিবাদী, মুজতাহিদ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ইসলাম জগতে চার খালীফার পরেই হযরত ইমাম আবু হানিফা যে সবচাইতে অধিক সম্মানিত ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, একথা বলাই বাহুল্য । যুক্তি-তর্ক এবং ইজতেহাদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। এ ক্ষেত্রে এমনিক তাঁহার প্রখ্যাত ওস্তাদগণও প্রিয় শাগরেদের ভূয়সী প্রশংসা করিতেন এবং সেরা যুক্তিবাদী ও শরীয়ত বিশারদ বলিয়া অকপটে স্বীকার করিতেন ।

এ ব্যাপারে তাঁরই ওস্তাদ হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর একটা ঘটনা এখানে প্রণিধানযোগ্য

জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় স্বামী স্ত্রীকে বলিলেন তুমি আমার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত আমি তোমার সাথে আদৌ কথা বলিব না-ইহা আমার কসম।

স্ত্রীও রাগের মাথায় কসম করিয়া বলিল- 'তুমিও আমার সাথে কথা না বলা অবধি আমি তোমার সাথে কথা বলব না।'

স্বামী-স্ত্রীর এ প্রকার কসম করার পর উভয়ের মধ্যকার যাবতীয় কথাবার্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল।

কিছু সময়ের পরে উভয়ের মেজাজ ও ক্রোধ প্রশমিত হলে তাহাদের ক্রোধ কালীন আচরণের কথা মনে করিয়া নিদারুণ অনুতপ্ত ও দুঃখিত হল। শুধু তাই নয়-নিজেদের ভুল ও সমুহ কথা স্মরণ করে চিন্তিত হল। ব্যাপারটি যে কত বড় গুরুত্বপূর্ণ তা তারা ইতিপূর্বে অনুধাবন করতে পারছিল না। কিন্তু এখন তারা উভয়ে পিবদে পড়ে গেল।

অনন্যোপায় হয়ে লোকটি ইমাম আবু হানিফার প্রখ্যাত ওস্তাদ হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর কাছে গেল এবং বিষয়টি তাঁর কাছে সবিস্তার আলোচনা করল এবং এর সমাধান তাঁর কাছে প্রার্থনা করল।

হযরত ছুফিয়ান ছারী সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন- “কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা ব্যতীত কেউ কারো সাথে কোন প্রকার কথাবার্তা বলতে পারবে না।

হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর এ ফতোয়া শুনিয়া লোকটি ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হইল। মনের শান্তি ও তৃপ্তির জন্য এ বিষয়টি নিয়ে সে ক্রমান্বয়ে আরো কয়েকজন প্রখ্যাত আলেমের কাছে গেল। তাঁরাও ঘটনার বিবরণে ঐ একই কথা বলে তাকে বিদায় দিয়ে দিলেন।

অবশেষে লোকটি গিয়া উঠিলেন হযরত ইমাম আবু হানিফার কাছে। উক্ত বিষয়টির আদ্যপান্ত সকল বিষয় তাঁর কাছে প্রকাশ করে ধরলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন- এর জন্য তোমাকে ঘাবড়াতে হবে না। এক্ষুণি যাও, আপন স্ত্রীর সাথে পূর্ববৎ কথাবার্তা বলতে থাক, কোনই অসুবিধা নেই । আর এজন্য কসম ভঙ্গের কোন প্রকার কাফ্ফারাও দিতে হবে না, অবাধে কথা বলতে পার।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এ ফতোয়া দিয়ে লোকটিকে ছেড়ে দিতে বেশী দেরী নেই- এহেন ফতোয়ার সংবাদ গিয়ে পৌছিল হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর কাছে। এতে তিনি যেমন বিরক্ত হলেন, তেমনি হলেন বিস্মিত। দুঃখের সাথেই তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে ডেকে বললেন-এ প্রকার অপরিণামদর্শির ন্যায় যা তা ফতোয়া দিয়ে লোকদের বিভ্রান্ত করছেন, নিজেও হচ্ছেন, গুনাহগার, এ কেমন কথা- জ্ঞানের স্বীকৃতি তো এটা নয় ।'

ইমাম আযম তখনি উক্ত ব্যক্তিকে পুনরায় হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর দরবারে ডাকালেন এবং তারই সম্মুখে বিষয়টির খুঁটিনাটি সবকিছু শুনলেন। অতঃপর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন : পূর্বেআমি এ বিষয় যে সিদ্ধান্ত ও ফতোয়া দিয়েছি- তাই ঠিক, অনুরূপ ফতোয়া এখনো দিচ্ছি স্বামী-স্ত্রীর কারো কথা বলায় তাদেরকে কসমের কাফ্ফারা দিতে হবে না ।

উপস্থিত ক্ষেত্রে হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর পুনঃ ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মুখে একথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন এবং বললেন

বলুন তোঃ এমনটি হল কি করে?
জবাবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন- স্বামী কসমের কথা বলার পরে তার স্ত্রী যখন তার স্বামীকে কসমের কথা জানাল, তখনই স্বামীর কসম মূল্যহীন হয়ে গেল- তার কসম আর প্রতিষ্ঠিত হল না। সুতরাং স্বামী তার স্ত্রীর সাথে কথা বলার এখন আর কসমের কোনই বাধা অবশিষ্ট রইল না।
অপরদিকে স্বামীর সাথে কথা বলা অর্থাৎ কসমের কথা বলায় স্ত্রীর কসমও কার্যকরী ও প্রতিষ্ঠিত হল ন। অতএব, একই কারণে স্ত্রীরও কসমের কাফ্যারা দিতে হবে না।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর যুক্তি শুনে এতক্ষণে হযরত ছুফিয়ান ছাওরীর ভুল ভাঙ্গিল- বিষয়টিতে তরিয়ে দেেিলন- ইমাম আবু হানিফা ঠিকই বলছেন। ফলে হযরত ছুফিয়ান ছাওরী অকপটে বলে ফেললেন- সত্যি বলতে কি, আপনার মাথায় যে বুদ্ধি হঠাৎ ঘটে, তা আমাদের কল্পনারও অতীত।

এতো গেলো শরীয়তী একটি মাসয়ালার সমাধানের যুক্তি। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এ প্রকার ভুরি ভুরি অকাট্য যুক্তি ও বিজ্ঞতার পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি। এখানে তাহার একটি ঘটনা মাত্র আলোচনা করব ।

আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে খলিফা মনছুর ছিলেন অসাধারণ যুক্তিবাদী, কূটনীতিবিদ, সমরবিশারদ এবং বলতে গেলে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। হযরত ইমাম আবু হানিফা ছিলেন হযরত জয়নাল আবেদীনের পৌত্র এহিয়া ও নফছে জাকিয়ার সমর্থক। অর্থাৎ তারই খলিফা হওয়ার যোগ্যতম পাত্র। এদিকে সারা মুসলিম দুনিয়ার ইমাম আবু হানিফার প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল নির্ভেজাল। বলতে গেলে মুসলমানের ৭৫ ভাগ লোকই ছিল তার ভক্ত, অনুরক্ত এবং সমর্থক। এসব কারণে খলিফা মনছুর তাকে সংশয় ও সন্দেহের নজরে দেখত। তিনি এর সমাধান হিসাবে ভাবলেন, যে কোন প্রকারেই হোক, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে সরকারী কাজে নিয়োগ কেিত পারলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। এ উদ্দেশ্য সম্মুখে রেখে খলিফা মনছুর তাকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠালেন।

যথাসময় তিনি মনছুরের দরবারে এসে পৌঁছলেন। খলিফা মনছুর তাকে কাজীউল কোজাত বা প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাব দিলেন। এতে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অসম্মতি জ্ঞাপন করে বললেন-

: আমাকে এ বিষয় ক্ষমা করবেন- আমি এ পদের অযোগ্য। খলীফা মনছুর আগে হতেই হযরত ইমাম আযমের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিদ্যা এবং বিচক্ষণতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। তাই তিনি কিছুটা সরোষে বললেন
: আপনি কেন অকারণে মিথ্যা কথা বলে আমার ইচ্ছা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন? আমি ভালভাবেই জানি সারা রাজ্যের মধ্যে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে এ পদের সম্পূর্ণ যোগ্যতম।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) শান্ত এবং বলিষ্ঠ কূটনীতিমূলক উত্তর দিলেন
: আমার কথা যদি সত্যি হয় তবে, আমি এ পদের অযোগ্য। আর যদি আমার কথা মিথ্যা ও আপনার কথা সত্য হয়, তবু আমি এ পদের একান্তই অযোগ্য। কারণ কোন মিথ্যাবাদীকে এ প্রকার গুরুত্বপূর্ণ প্রধান কাজীর পদে নিয়োগ করা সমীচীন নয় ।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কূটনীতিপূর্ণ এ প্রকার অখণ্ডনীয় জবাব শুনে খলিফা মনছুর হতভম্ব হয়ে গেলেন- এরপর তাঁকে আর প্রধান কাজী কিংবা সরকারী কোন পদেই নিয়োগ করতে চাওয়ার সুযোগ আর অবশিষ্ট রইল না। কারণ খলিফা নিজের কথায়ই নিজে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কাছে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url