দুর্নীতি দমনে হযরত ওমর (রা.)-এর কঠোর পদক্ষেপ।
সরকারি কর্মচারীদের নানা উপায়ে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ থাকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুযোগে রাজকর্মচারীগণ সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করে থাকেন। তবে সরকারের কড়া নযর থাকলে দুর্নীতির প্রকোপ কিছুটা কম হয়।
ব্রিটিশ আমলে উৎকোচ প্রথা রাজকর্মচারীদের মধ্যে কমবেশি প্রচলিত থাকলেও সরকারের নিজস্ব অর্থের পরিমাণ তখন কম ছিল। সরকারি কর্মচারীগণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করতে ভয় পেতেন। ২৫০ টাকা আত্মসাতের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করতে সরকার তখন দ্বিধাবোধ করতেন না। ফলে রাজকর্মচারীগণ জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করলেও সরকারি অর্থ অপচয়ে অত্যন্ত ভয় পেতেন।
দু'শ বছর ধরে সরকারি অর্থ অপচয়ের বিরুদ্ধে যে ভীতি সৃষ্টি করতে বৃটিশ সরকার সমর্থ হয়েছিল, তা নষ্ট করতে আযাদ দেশের আযাদ সরকারের অর্ধ যুগও দরকার হয়নি। শতাব্দীব্যাপী গড়ে ওঠা ঐতিহ্য যে কত তাড়াতাড়ি নষ্ট হতে পারে তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। জনগণের রক্ত পানি করা অর্থের প্রতি সরকারি কর্মচারীদের দরদ খুবই কম।
সরকারি সম্পদের জন্য হযরত ওমর (রা)-এর দরদ স্বীয় সম্পদের চেয়েও বেশি ছিলো। কারণ তিনি মনে করতেন খিলাফত পবিত্র আমানত, যার জন্য তাঁকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অর্থ অপচয় এবং আত্মসাতের জন্য নামজাদা লোকদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। হযরত ওমর (রা)-এর জীবনযাত্রা ছিলো অত্যন্ত সরল এবং সাদাসিধে। তা'কাতে ইবনে সা'দে দেখা যায়, হযরত ওমর (রা)-এর একটি জামা ও একটি জোব্বা ছিলো, যাতে বহু তালি লাগান ছিল।
-তারকাতে ইবনে সা'দ : তৃতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ, ২৩৭ পৃষ্ঠা
হযরত ওমরের খিলাফত আমলে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অতি দ্রুত তদন্ত করা হত। অভিযুক্ত কর্মচারী উচ্চপদস্থ হলে কয়েক ব্যক্তি সমবায়ে গঠিত কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করা হত। মুহম্মদ বিন মাসলামা আনাসারী (রা) প্রধান ইনকোয়ারী অফিসার নিযুক্ত হন। মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা) ছিলেন রসূল (স)-এর একজন প্রিয় সাহাবী। তিনি বহু যুদ্ধে মহানবী (স)-এর অনুগমন করেছিলেন। এক অভিযানের সময়ে মহানবী (স) তাকে মদীনায় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে যান। সততা এবং ন্যায়পরায়ণতার জন্য হযরত মাসলামা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধাভাজন। এ সমস্ত কারণে খলীফা ওমর (রা) মাসলামা আনসারীকেই প্রধান তদন্তকারী অফিসার নিযুক্ত করেন।
বীর সেনানি খালিদের পদচ্যুতি এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
হযরত ওমর (রা) সরকারি অর্থ অপচয়ের অপরাধে নামজাদা লোকদেরও কঠোর শান্তি থেকে রেহাই দিতেন না। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)-এর মত রণ-নায়ক বিশ্বের সমর ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। এহেন সেনাপতিকে পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য হযরত ওমর (রা) পদচ্যুত করেন এবং তাঁর অধিকাংশ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ।
আমর বিন আল-আসের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
হযরত ওমর (রা) খবর পেলেন, হযরত আমর ইবনুল আস (রা)-এর সম্পত্তি অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। মিসরে যাওয়ার পূর্বে তাঁর যা সম্পদ ছিল তা থেকে পরবর্তী আমলের সম্পদ অনেক বেশি। হযরত ওমর (রা) মিসর-বিজয়ী বীর আমর ইবনুল আস (রা)-এর অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ।
বিলালের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ
হযরত বিলাল (রা) তাঁর জমিজিরাত উত্তমরূপে চাষাবাদ করতে পারেননি, এ অপরাধে তাঁর জমি হযরত ওমর (রা) রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেন।
আবূ হুরায়রার মালামাল বাজেয়াপ্ত
হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-কে হযরত ওমর (রা) প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিছুকাল পরে হযরত ওমর (রা) জানতে পারেন, গভর্নর আবূ হুরায়রা (রা)-এর সম্পদ বেড়েছে। খলীফা আবূ হুরায়রা (রা)-কে তলব করে আনেন এবং তিনি দুই উট বোঝাই মালামাল নিয়ে মদীনায় আসেন। এ মালামাল সম্বন্ধে হযরত আবৃ হুরায়রা (রা) জানান, তিনি কিছুই সরকারি কোষাগার থেকে আত্মসাৎ করেননি। এবং সবকিছু তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। খলীফা এতে সন্তুষ্ট হননি। ক্রুদ্ধ খলীফা চিৎকার করে বলেন, “যখন আমি তোমাকে গভর্নর নিযুক্ত করি, তখন তোমার পায়ের জুতা জোড়াও ছিল না। আজ তুমি কি করে এত মালের অধিকারী হলে?” এই বলে তিনি হযরত আবূ হুরায়রার মালামাল বাজেয়াপ্ত করেন।
আবু সুফিয়ানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত
হযরত মুয়াবিয়া (রা) সিরিয়ার গভর্নর থাকাকালে তদীয় পিতা আবূ সুফিয়ান একবার সিরিয়ায় আসেন। হযরত ওমর (রা) সন্দেহ করলেন, হয়ত আমীর মুয়াবিয়া (রা) তাঁর পিতাকে অর্থ সাহায্য করে থাকেন। তিনি আবূ সুফিয়ানকে ডাকলেন এবং তাঁকে বললেন, “মুয়াবিয়া তোমাকে যা দিয়েছে তার কিছু আমাকে দাও।” আবূ সুফিয়ান কোন কিছু এনেছেন বলে স্বীকার করলেন না, কিন্তু হযরত ওমর (রা)-এর সন্দেহ কিছুতেই ঘুচল না। তিনি অন্য পথের আশ্রয় নিলেন।
বলপূর্বক হযরত ওমর (রা) আবূ সুফিয়ানের হাত থেকে তার অঙ্গুরীয় ছিনিয়ে নিলেন এবং অঙ্গুরীয় সমেত বায়তুল মালের জনৈক কর্মচারীকে আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার কাছে এই বলে পাঠালেন যে, আবু সুফিয়ান পাঠিয়েছেন। তিনি সিরিয়া থেকে যে বাক্সগুলো এনেছেন তা অর্পণ করুন। হিন্দা অঙ্গুরীয় দেখে অবিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি সব কিছুই দিয়ে দিলেন। বাক্সগুলো খুলে হযরত ওমর (রা) কয়েক হাজার আশরাফি পেলেন এবং সব কিছুই বায়তুল মালে জমা করে দিলেন।
সরকারি কর্মচারীদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধকরণ
আজকাল সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে জমি কেনার হিড়িক দেখা যায়। উন্নয়নশীল শহরগুলোতে সরকারি কর্মচারীগণ সুবিধামত অল্প দামে জমি কিনে অল্প সময়ে বড় লোক হচ্ছেন। হযরত ওমর (রা)-এর সময়েও এরূপ প্রবণতা সরকারি কর্মচারী এবং বৃত্তিভোগীদের মধ্যে ছিলো। হযরত ওমর (রা) তাঁর আমলে এমন এক “কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র” গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক সরকারি বৃত্তি পেতেন এবং যেকোনো কর্মচারী বা বৃত্তিভোগীর জন্য জমি ক্রয় নিষিদ্ধ ছিল।
ইবনে সা'দ মিসরে জমি কিনেছিলেন। কিন্তু তা রাখতে পারেননি। হযরত ওমর (রা)-এর কঠোর নির্দেশ স্মরণ করে তিনি তা প্রত্যর্পণ করেন। তেমনি হযরত তালহা (রা) জমি কিনেছিলেন কুফায়। তাঁকেও সে জমি রাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করতে হয়েছিলো।
তানতাবি তাঁর “নিযামুল আলম ওয়াল ইসলাম” গ্রন্থে লিখেছেন, “হযরত ওমর (রা)-এর আমলে সরকারের আয় বৃদ্ধি পায়। সরকারি কর্মচারী, সুধী এবং জ্ঞানীদের বেতন ও ভাতা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তখন নিয়মিত ভাতাভোগীদের তালিকা তৈরি করা হয়। জমিদারীর অবসান ঘটে। জমির বর্গা এবং ইজারা নিষিদ্ধ করা হয়। অভাবী এবং গোলামদের ভাতা (মুক্তির জন্য) নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।”
হযরত আবদুল্লাহ্ বিন যুবায়ের (রা) বলেন, “ওমর বিন খাত্তাব ফরমান জারি করেন, যেহেতু মুসলিম নাগরিকের জন্য ভাতা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাই তারা (ভাতাপ্রাপ্ত সাহাবী) চাষাবাদও করবে না এবং জমির অধিকারীও হতে পারবে না।”
-হুসনুল মুহাজিরা; পৃষ্ঠা ৭
শরিফ বিন সুমাইয়্যা মিসরের গভর্নর আমর বিন আল আসের নিকট আপত্তি জানান। যে, তাঁর ভাতা পর্যাপ্ত নয়। অতঃপর খলীফার হুকুম না নিয়েই তিনি জমি দখল করে চাষাবাদ শুরু করেন। হযরত ওমর (রা) শরিফকে তলব করেন এবং বলেন, “আমি তোমাকে এমন কঠোর শাস্তি দেব যা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।” অনুতপ্ত শরিফ ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ওমর তাঁকে ক্ষমা করে দেন।
-মাওলানা হিফযুর রহমান : ইসলাম কা ইকতিসাদী নিযাম