ইমাম আবু হানিফা (রহ.) থেকে বর্ণিত হাদীস সংখ্যা কত?
অল্প সংখ্যক হাদীস বর্ণনার অপবাদ ভিত্তিহীন
হযরত আলী (রা.) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন। চব্বিশটি বছর তিনি রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সাহচর্যে কাটান। অথচ তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৮৬টি। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-এর হাদীসের সংখ্যা ৮৪৮টি অথচ তিনি বাইশটি বছর রাসূলুল্লাহ (স.)-এর খাদেম হিসেবে তাঁর সাহচর্যে অতিবাহিত করেন।
এঁদের সকলেই নিজ নিজ বর্ণিত হাদীস থেকে অনেক গুণ বেশী হাদীস জানতেন। কিন্তু অত্যাধিক সতর্কতা অবলম্বন করার কারণে খুবই কম হাদীস বর্ণনা করতেন । কারণ হাদীস বর্ণনায় সামান্যতম ভুলেও শাস্তির ধমক রয়েছে। এ কারণে তাঁরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (স.)-এর দিকে সম্পর্কিত করে হাদীস বর্ণনা করতেন না। অবশ্য তাঁরা আহকাম এবং মাসআলা আকারে হাদীস বর্ণনা করতেন। 'আল এসাবা' নামক কিতাবে বর্ণিত যে, হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত ইবনে উমর (রা.) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত যায়েদ বিন ছাবেত (রা.), হযরত আয়েশা (রা.) প্রমুখের ফতোয়া এত অধিক যে, সেগুলো জমা করলে প্রত্যেকের বর্ণিত মাসআলা ও ফতোয়াই একেকটি কিতাবাকার ধারণ করবে।
হাদীস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এবং তাঁর শাগরেদগণ সাহাবায়ে কিরামের পথ অনুসরণ করেছেন। যে হাদীসই তারা শ্রবণ করেছেন তাই বর্ণনা করেননি। বরং তারা হাদীসের মধ্যে নাসেখ-মনসুখ দুর্বল শক্তিশালী ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে যেটা গ্রহণযোগ্য সেটাই বর্ণনা করতেন। অধিকন্তু তারা সাহাবায়ে কিরামের আমল, তাঁদের ফতোয়া এবং বাণী দ্বারা হাদীস নিরূপণে সাহায্য নিতেন। ইমাম আবু হানিফা এ সব প্রশংসনীয় দিকের কারণে তাঁর শত্রুরা ঈর্ষাকাতর হয়ে এ অপবাদ দিচ্ছে যে, তিনি খুব সীমিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর অল্প সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করার সমালোচনার আরেক উত্তর এভাবে দেয়া হয়ে থাকে যে, হাদীস মূলতঃ দু'প্রকারের। এক প্রকারের হাদীস আহকামের সাথে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় প্রকারের হাদীস আহকামের সাথে সম্পর্কিত নয়।
দ্বিতীয় প্রকারের হাদীস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরাম এবং ইমামগণ অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। বরং খোলাফায়ে রাশেদীন এ প্রকারের হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত রয়েছেন এবং অন্যদেরকেও তার বর্ণনা করা থেকে নিষেধ করেছেন। আর আহকামের সাথে সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করা থেকে নিষেধ করতেন না। বরং সেগুলো বর্ণনা করার জন্য জোড় দিতেন। খলীফা হওয়ার পর হযরত উমর (রা.) বলেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ (স.)-এর হাদীস কম বর্ণনা কর। তবে যেগুলো আমলের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো বর্ণনা কর।
হযরত উবাদা বিন ছাবেত (রা.) বলেন, যে সকল হাদীসে তোমাদের ধর্মীয় উপকার রয়েছে, সেগুলো সব আমি বর্ণনা করে দিয়েছি।
হযরত উবাদা (রা.)-এর এ বাণীর ব্যাখ্যায় কার্যী আয়ায (রহ.) বলেন, এ কথা যারা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি সে সব হাদীস রেওয়ায়েত করেননি যেগুলোতে মুসলমানদের কোন ফিৎনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কিংবা যেগুলো প্রত্যেকেই বুঝতে পারবে না। আর এগুলো সে সব হাদীস যেগুলো আহকামের সাথে সম্পর্কিত নয়। এ ধরনের হাদীস রেওয়ায়েত করা থেকে হযরত উবাদা বিন ছাবেত (রা.) -ই বিরত থাকেন নি বরং অন্যান্য অনেক সাহাবীও এরূপ করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও খোলাফায়ে রাশেদীন এবং বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামের আদেশাবলীর প্রতি লক্ষ্য রেখে শুধুমাত্র সে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন যেগুলোর সম্পর্ক আহকামের সাথে।
হযরত শাহ গুলীউল্লাহ মুহাদ্দেছে দেহলাভী (রহ.), হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.) এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রা.)-কে তাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অল্প হওয়া সত্ত্বেও অধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে শামিল করেছেন। তিনি লিখেন, সকল মুহাদ্দিছগণই অধিক হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে আটজন সাহাবীকে সাব্যস্ত করেছেন, এঁরা হচ্ছেন হযরত আবু হোরায়রা (রা.), হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.), হযরত আনাস (রা.), হযরত জাবের (রা.), হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.)। আর হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.) এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রা.)-কে মাঝারি সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। তবে এ ফকীহের মতে এদের থেকেও অনেক হাদীস বর্ণিত রয়েছে। কারণ বাহ্যতর সে সব হাদীস মাওকুফ, বস্তুত : সেগুলো মরকু। আর এঁদের থেকে ফিকহ, ইহসান এবং হিকমত সম্পৰ্কীয় যে সব হাদীস বর্ণিত রয়েছে, বিভিন্ন কারণে সেগুলোও মরফু এর পর্যায়। এতএব, তাঁদেরকে অধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে শামিল করাই উচিৎ হবে।
উল্লেখিত তিনজন সাহাবীর প্রত্যেকের থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা পাঁচশ থেকে হাজারের মধ্যে। এঁদেরকে যদি অধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে শামিল করা সঠিক হয়ে থাকে তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে যার বর্ণিত মরফু হাদীস ব্যতীতও মওকুফ হাদীস, মাসায়েল, ফতোয়া ইত্যাদি হাযার হাযার পৃষ্ঠাব্যাপী রয়েছে তাঁকে কোন মতেই অল্প সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে শামিল করা সমীচীন হবে না।
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মসরূক (রহ.) বলেন, আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম যে, সমস্ত ইলমের ভাণ্ডার হচ্ছেন হযরত উমর (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত যায়েদ (রা.), হযরত আর দারদা (রা.) এবং হযরত উবাই (রা.)। এরপর আরো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম যে, এদের সবার সমস্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার হচ্ছেন হযরত আলী (রা.) এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রা.)।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর শত্রুরা তাঁর বিরূপ মন্তব্য ও দোষ তালাশেই লিপ্ত রয়েছে। মুহাদ্দিছগণ এবং ফকীহগণ তাঁর যে সমস্ত গুণাবলীর সাক্ষ্য দিয়েছেন, তার প্রতি কোন লক্ষ্যই তাদের নেই। তারা পূর্বেকার কোন কোন লিখকের অনুসরণে তাদের রচনাবলী হতে উদ্ধৃতি দিয়ে তার সমালোচনা করে থাকে সে সমস্ত উদ্ধৃতি কিংবা রেওয়ায়েত মিথ্যা। গ্রহণযোগ্য হবার জন্য ইমামদের দিকে সেগুলোকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আর যদি সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তবে তার কারণ হবে অজ্ঞতা এবং ভুল বুঝাবুঝি। যেমন ইমাম আওযায়ী (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ব্যাপারে ভুল ধারণা নিয়েছিলেন। পরে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হলে তার ভুল ধারণার অবসান হয়। তদ্রূপ যাদের লেখায় কিংবা কথায় ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বিরূপ মন্তব্য উল্লেখ রয়েছে সেটি তাদের ভুল ধারনার কারণে হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে তারা কখনও এধারনা করত না।
যারা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দোষত্রুটি বর্ণনা এবং তাঁর সমালোচনা করেছেন তাদের প্রত্যেকে আবার ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর প্রশংসাও করেছেন। এটা তখনই সম্ভব যখন তাদের ভুলের অবসান হয়ে থাকে। আর ভুল ধারনার অবসান তখনই হবে যখন তার মেধা, জ্ঞান প্রভৃতি গুণাবলী সম্বন্ধে সঠিক ধারনা হয়ে থাকে। আর তাঁর সাথে সাক্ষাত করা ছাড়া তাঁকে সঠিকভাবে জানা ও চেনা অসম্ভব।
একবার মদিনা মুনাওয়ারায় ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সাথে ইমাম মালেক (রহ.)-এর সাক্ষাত হন। দীর্ঘ সময়ব্যাপী উভয়ের মাঝে ইলমী আলোচনা হল।
ইমাম মালেক (রহ.) যখন সেখান থেকে উঠে এলেন তখন তাঁর সমস্ত দেহ ঘর্মাক্ত ছিল। লাইছ বিন সাদ তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আবু হানিফার সাথে বহছ-মুবাহাছা করতে করতে ঘর্মাক্ত হয়ে গেছি। নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি একজন বড় ফকীহ।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সমালোচনামূলক যে সমস্ত মন্তব্য ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর দিকে সম্পর্কিত করা হয় তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ওফাতের বছর ইমাম শাফেয়ী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। সুতরাং তিনি তাঁর সম্পর্কে সমালোচনা করতে পারেন না। বরং তিনি দীর্ঘদিন ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর নিকট থেকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর পিকাহর জ্ঞান হাসিল করেন। তিনি আবু হানিফার ছাত্রের ছাত্র হয়ে কি করে তাঁর সমালোচনা ও বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন। বরং তিনি বলেন,
الناس عيال في الفقه على أبي حنيفة
যে সকল লিখক বিভিন্ন ইমাম এবং ফিকহবিদদের থেকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সমালোচনামূলক মন্তব্য স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে খতীবে বাগদাদী একজন। নিম্নে তার কয়েকটি মন্তব্য উল্লেখ করা হল।
আবু হানিফা হাদীসের ক্ষেত্রে এতীম এবং পঙ্গু ছিলেন। তিনি হাদীসের লোক ছিলেন না।
আবু হানিফার নিকট রায়ও ছিল না হাদীসও ছিল না। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশ' পঞ্চাশটি। এর অর্ধেকগুলোতে আবার তিনি ভুল করেছেন। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন তার ইতিহাসের মুকাদ্দামায় লিখেন,
আবু হানিফার হাদীসের সংখ্যা সতেরটি পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে বর্ণিত আছে। ৰাস্তবে এটা কতটুকু সঠিক তা পূর্বের আলোচনা দ্বারাই বুঝা গেছে।
পাঠকদের সামনে এসব অপবাদ ও বিরূপ মন্তব্যের কয়েকটি উত্তর লেখা হচ্ছে।
১। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সর্বজন স্বীকৃত ইমাম এবং ফকীহে মুজতাহিদ ছিলেন। খতীবে বাগদাদী যাদের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তারাও এ ব্যাপারে একমত। এখন প্রশ্ন জাগে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যখন হাদীস: জানতেন না, মাত্র সতেরটি হাদীস মুখস্ত ছিল, তখন কি করে অন্যান্য ইমাম এবং মুজতাহিদগণ তার মাযহাব গ্রহণ করেছেন? তাঁর ফেকহী মাসায়েল শিক্ষা করে তা প্রচার ও প্রসার কেন করেছেন?
৩। ইবনে আবি শাইবার মতে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এমন মাসয়ালার সংখ্যা একশ পঁচিশটি যেগুলো সহীহ হাদীসের বিপরীত। তার একথাটি সঠিক বলে মেনে নিলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে, এ গুটি কতক মাসয়ালা ছাড়া অন্য সব মাসয়ালা সহীত হাদীসের অনুরূপ। আর ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর উদ্ঘাটিত মাসয়ালার সংখ্যা এক বর্ণনামতে তিরাশি হাযার। অন্য এক বর্ণনা মতে বার লক্ষ ।
অর্থাৎ, প্রায় বার লক্ষ মাসয়ালা সহীহ হাদীসের অনুরূপ। এতে এ কথা প্রমাণ হয় যে, তিনি হাদীসের বিরাট একটা অংশের জ্ঞানী ছিলেন। সেগুলো থেকে তিনি এ সমস্ত মাসয়ালা এস্তেম্বাত করেন।
৪। উসুলে হাদীসের কিতাবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতামত লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ কোন রাবী গ্রহণযোগ্য কি বর্জনযোগ্য এ ব্যাপারে তাঁর মত গ্রহণযোগ্য। এমন ব্যক্তিত্বকে হাদীসের ব্যাপারে এতীম বলা কি মিথ্যা অপবাদ নয়?
৫। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ছাত্রগণ তাঁর থেকে শ্রুত এবং পঠিত হাদীসগুলো কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। সংকলনকারীগণও ছিলেন বিশিষ্ট ইমাম এবং মুজতাহিদ। যেমন ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম হাসান, ইমাম যুফার (রহ.) প্রমুখ। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মুসনাদের সংখ্যা সতেরটি। "জামেউল মাসানিদ” নামক কিতাবে এর অনেকগুলোকে লেখা হয়েছে।
ইবনে খলদুন বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সতেরটি, এর এক অর্থ এটা হতে পারে যে, তার মুসনাদের সংখ্যা সতেরটি। এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদে তেরটি এবং ইমাম আবু ইউসুফ থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চারটি। মোট সতেরটি। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সতেরটি এর উপর ভিত্তি করেই বলা হয়। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা। ইবনে খলদুল ব্যতীত আর কেউ এটা বর্ণনা করেনি।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর নামে আকেরটি মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি মুরজিয়া ছিলেন। মুরজিয়াদের মতে কোন মুসলমান ব্যক্তি যত গুনাহই করুক এতে তার কোন অসুবিধা হবে না। যেমনিভাবে কোন কাফের যত নেক কাজই করুক, এতে তার কোন ফায়দা হবে না।
অপরদিকে খারেজীদের আকীদা এরূপ যে, কোন মুসলমান যদি কবীরা গুনাহ করে তবে সে ইসলামের সীমারেখা থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যায় এবং সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। আর মু'তাযিলাদের আকীদা এরূপ যে কোন মুসলমান যদি কবীরা গুনাহ করে তবে সে ইসলামের সীমারেখা থেকে বের হয়ে যাবে। তবে সে কাফের হবে না।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর আকীদা এ দু'ধরনের আকীদার, মাঝামাঝি। তিনি বলেন যে, গুনাহে কবীরার কারণে কোন মুসলমান অমুসলমান হয়ে যায় না। তবে এমনও নয় যে, গুনাহ তার কোন ক্ষতি করে না। বরং পরকালে তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। তবে আল্লাহ চাইলে তাকে মাফ করতে পারেন। অনন্তকাল সে জাহান্নামে থাকবে না।
إن الله لا يغف أن يشرك به ويغفر ما دون ذالك لمن يشاء
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা শিরক এর গুনাহ মাফ করেন না; এ ছাড়া অন্য সব গোনাহ মাফ করেন।
اما المرجئة فيهم بعض اصحاب ابي حنيفة.
ইমাম আবু হানিফা এবং ফিকহ ও ফতোয়া ইবনে কাইয়েম (রহ.) 'এনামুল মু'আকেক 'দ্বীন' কিভাবে লিখেন যে, ইবনে মাসউদ, যায়দ বিন ছাবেত, আব্দুল্লাহ বিন উমর, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) প্রমুখের ছাত্রদের দ্বারাই দ্বীন, ফিকহ এবং ইলম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
মদীনাবাসীরা যায়দ বিন ছাবেতের এবং ইবনে উমরের শাগরেদদের থেকে, মক্কা বাসীরা ইবনে আব্বাসের শাগরেদদের থেকে এবং ইরাকবাসীরা ইবনে মাসউদের শাগরেদদের থেকে ইলম ও দ্বীন হাসিল করে।
ইবনে মাসউদের কূফার শাগরেদদের মধ্যে আলকামা বিন কায়স রাসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবিত থাকাবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে মাসউদ ছাড়াও তিনি হযরত উমর (রা.), হযরত উছমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত সা'দ (রা.), হযরত হুযাইফা (রা.), হযরত আবু দারদা (রা.), হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা.), খালেদ বিন ওলীদ (রা.), হযরত আয়েশা (রা.) প্রমুখ সাহাবীদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। সাহাবায়ে কিরাম আলকামা বিন কায়স থেকে ফতোয়া জানতেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের (রা.) ইলমের সটিক উত্তরসূরী ছিলেন আর ইব্রাহীম বিন ইয়াযীদ নাখয়ী আলকামা থেকে ইলমে ফিকহ হাসিল করেন। অন্যান্য ভাবেয়ীনদের থেকেও তিনি ফয়ের হাসিল করেন। তিনি আলকামার ভাগ্নে ছিলেন। আবুল মুছান্না রাবাহ এ দুজন সম্পর্কে বলেন,
তুমি যদি আলকামাকে দেখ কিন্তু ইবনে মাসউদকে দেখনি তাহলে কোন আফসোস নেই। কারণ তিনি ইবনে মাসউদের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর যদি ইব্রাহীমকে দেখ, তাহলে আলকামাকে না দেখায় কোন আফসোস নেই ।
আর ইব্রাহীম নাখয়ী থেকে হাম্মাদ বিন আবি সুলাইমান ইলমে ফিকহ হাসিল করেন। এ ছাড়াও তিনি সায়ীদ বিন মুসাইয়্যাব, সায়ীদ বিন জুবাইর, ইকরামা, হাসান বসরী, শাবী (রহ.) প্রমুখ থেকে ইলমে দ্বীন হাসিল করেন।
তাঁর থেকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইলমে ফিকহ এবং ফতোয়া শিক্ষা লাভ করে ফিকহর প্রসার এবং তাঁর থেকে অনেক ছাত্র এবং শিষ্য ইলমে ফিকহ এবং ফতোয়া হাসিল করেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর শাগরেদদের সংখ্যা ছিল অগণিত। তাঁদের মধ্য হতে বিশিষ্ট চল্লিশজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন এবং এঁদেরকে নিয়েই তিনি ফিকহী মাসয়ালা আলোচনা করতেন। এদের মধ্যে কেউ ফিকহ্ শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ছিলেন আবার কেউ ইলমে হাদীসে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাদের কয়েকজন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হলো।