কখন গীবত করা জায়েয?


যে সব ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয

(১) মাজলূম (তথা অত্যাচারিত) ব্যক্তির জন্যে জালিমের গীবত করা জায়েয। যাতে মানুষ তার জুলুম থেকে বাঁচতে পারে। যেমন কোন বিচারক বা কর্মচারী কারো উপর জুলুম করল বা কারো মাল ছিনতাই করল বা বে-ইয্যতী করল। তাহলে তার জন্যে আদালতে যেয়ে উক্ত জুলুমের বর্ণনা দেয়া ও বিচারপ্রার্থী হওয়া জায়েয।


(২) যদি কেউ কারো অন্যায় বা দোষ সম্পর্কে অবগত হয় এবং এমন ব্যক্তির কাছে যেয়ে তা আলোচনা করে যার বুঝান বা নিষেধের দ্বারা সে উক্ত অন্যায় বা দোষ হতে ফিরে আসবে, তাহলে গোনাহ থেকে রক্ষার খাতিরে এ ধরনের দোষ বর্ণনা করা জায়েয।


(৩) মাসআলা জিজ্ঞাসাকালে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করার জন্যে গীবত জায়েয। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আবু সুফিয়ানের স্ত্রীদের মধ্য হতে হিন্দা এসে নবী করীম (সাঃ) এর দরবারে এসে আরয করল, আবু সুফিয়ান লোকটি কৃপণ। সে আমাকে যে পরিমাণ খরচ দেয় তা আমার ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ ইত্যাদির জন্যে যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে আমি কি তার সম্পদ হতে তার অজান্তে এর জন্যে কিছু নিতে পারি? রাসূল (সাঃ) বললেন- তুমি তোমার ও তোমার সন্তান-সন্ততির জন্যে যে পরিমাণ স্বাভাবিক প্রয়োজন শুধু সে পরিমাণ নিতে পার। হিন্দা স্বীয় সন্তানাদির জন্যে প্রয়োজনীয় খরচ না দেয়ার কথা উল্লেখ করে আল্লাহর নবীর সম্মুখে স্বামীকে তার অসাক্ষাতে কৃপণ আখ্যায়িত করল কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে নিষেধ করেননি বা ধমক দেননি। কেননা সে কেবল মাসআলা জিজ্ঞাসার্থে এ কথা বলেছিল ।


(৪) সুপরামর্শ দানকল্পে পরামর্শ গ্রহণকারীর মঙ্গলার্থে প্রকৃত অবস্থা প্রকাশের জন্যে কারো দোষ উল্লেখ করা জায়েয। সহীহ মুসলিমে এ ধরনের একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, হযরত ফাতেমা বিনতে কায়স (রাঃ) হুযূর (সাঃ) এর দরবারে আরয করলেন- আবু সুফিয়ানের পুত্র মুআবিয়া ও আবু জাহম আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে। (এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কি?) হুযূর (সাঃ) বললেন- “আবু জাহম তো কাঁধের থেকে লাঠি নামায় না। অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে বেশী প্রহার করে। আর মুআবিয়া তো দরিদ্র মানুষ বরং তুমি উসামা ইবনে যায়েদের সাথে বিবাহ কর।”


এখানে পরামর্শের খাতিরে হুযূর (সাঃ) আবু জাহম ও মুআবিয়ার অসাক্ষাতে তাদের বাস্তব অবস্থা প্রকাশ করে দিলেন। এভাবে কোন দোষ বর্ণনার দ্বারা যদি কোন মুসলমানের মঙ্গল কামনা ও অন্যকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা জায়েয। যেমন- কেউ একজন চাকর রাখতে চায়। কিন্তু চাকরটি দুশ্চরিত্রবান। তাহলে মনিবের নিকট তার এ দোষ বলে দেয়া জায়েয। অথবা উদাহরণ স্বরূপ- যায়েদ আমরের সাথে উঠাবসা করে। যায়েদ লোকটি মদখোর বা যিনাকার। তাহলে আমরকে তার সংশ্রব হতে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে তার নিকট এ দোষ উল্লেখ করা জায়েয। এভাবে আরো বিভিন্ন উদাহরণ হতে পারে। মোট কথা যদি উদ্দেশ্য সৎ হয় এবং কোন মুসলমানের উপকার করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়। দোষচর্চার দ্বারা আত্মতৃপ্তি, হিংসা, ক্ষতি বা কাউকে কলুষিত করা উদ্দেশ্য না হয় । তাহলে এসব ক্ষেত্রে দোষ বর্ণনা করা জায়েয।


(৫) যদি কেউ এমন কোন উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় যা তার বিশেষ কোন দোষ বুঝায়। যেমন- জনৈক নাহু শাস্ত্রবিদ "আখফাশ” উপাধিতে খ্যাত ছিলেন। অথচ এর অর্থ হল “বাদুর চোখা” (অর্থাৎ যে সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না) অথবা কেউ খোড়া, লেংড়া ইত্যাদি উপাধিতে প্রসিদ্ধ । তাহলে এ নাম উল্লেখের দ্বারা গীবত সাব্যস্ত হবে না বরং তা জায়েয।


(৬) প্রকাশ্য ফাসেক অর্থাৎ যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গোনাহর কাজ করে। যেমন- দাড়ি মুন্ডন করে, বা প্রকাশ্যে মদ পান করে, বা যিনা করে, বা নাচ দেখে তাহলে তার দোষ বর্ণনা করা জায়েয। অর্থাৎ সে প্রকাশ্যে যেসব পাপ করে তার অসাক্ষাতে তা আলোচনা করা জায়েয। এতে সে গোনাহগার হবে না।


মাসআলা : যদি এক ব্যক্তির একই অবস্থা দু'ধরনে বর্ণনা করা যায়। আর এর একটির বচনভঙ্গিতে তার মনে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে। অন্যটিতে এ সম্ভাবনা না থাকে। তাহলে প্রথম প্রকারের বচনভঙ্গিতে সে গীবতকারী বিবেচিত হবে। আর দ্বিতীয়টিতে গীবতকারী সাব্যস্ত হবে না। যেমন-একজন অন্ধ/কানা ব্যক্তির অসাক্ষাতে তাকে অন্ধ/কানা বললে গীবত হবে। কিন্তু যদি পরিচয়দানের ক্ষেত্রে কেউ বলে যে, “লোকটির একটি চোখ নষ্ট” এতে তা গীবত হবে না। তদ্রূপ কোন লম্বা ব্যক্তিকে যদি “লাম্বু” বলে তাহলে তা গীবত হবে; কিন্তু দীর্ঘকায় বললে তা গীবত হবে না ।


মাসআলা : যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে কোন দল-গোষ্ঠী বা অনির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা করে। যেমন- বললো “অমুক শহরের মানুষ খুবই ধোঁকাবাজ, প্রতারক বা অমুক গ্রামের মানুষেরা নির্বোধ হয়ে থাকে” তাহলে তা গীবত হবে না ।


মাসআলা : যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির গীবত করে কিন্তু নাম উল্লেখ না করে তাহলে গীবত হবে না। কিন্তু যদি এমন ভাবে উল্লেখ করে যাতে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ তাকে চিনতে পারে, যেমন- বললো “নগরের কাযী বা সি. আই (পুলিশ কর্মকর্তা) এমন” বা এভাবে উল্লেখ করল না; কিন্তু উপস্থিতগণের মধ্য হতে কেউ বুঝতে পারল যে, অমুকের আলোচনা হচ্ছে তাহলে তা গীবত হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url