স্বামী-স্ত্রীর সাথে মিথ্যা বলা যাবে কি এবং কখন মিথ্যা বলা জায়েয, ও মিথ্যা বলার শাস্তি কি?

মিথ্যা বলার শাস্তি


কতিপয় ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েয।

যেমন (১) কোন মুসলমান ব্যক্তির জান, মাল বা ইযযত রক্ষার্থে মিথ্যা বলা জায়েয। যেমন- কোন জালিম ব্যক্তি একজনকে হত্যা বা তার ইযযত নষ্টের জন্য উদ্যত হল। ভয়ে সে কারো গৃহে আত্মগোপন করল জালিম লোকটি যদি সন্ধান লাভের জন্যে তার নিকট জিজ্ঞেস করে। তাহলে তার উত্তরে বলতে হবে “আমি জানিনা” বা “সে আমার গৃহে নেই।” এভাবে কোন মুসলমানের মাল অন্য একজনের কাছে সংরক্ষিত আছে। আর কোন জালিম ব্যক্তি তার থেকে উক্ত মাল ছিনিয়ে নিতে চায়। তাহলে সে বলবে যে, উক্ত মাল আমার নিকট নেই। এ জাতীয় ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাই ওয়াজিব । সত্যটা প্রকাশ করা নাজায়েয। তদ্রূপ নিজ জান-মাল বা ইষ্যত রক্ষার খাতিরে মিথ্যা বলাও জায়েয। যেমন দু'ব্যক্তির মধ্যে বন্ধুত্ব আছে। এর মধ্যে একজনের নাম যায়েদ। যায়েদের সাথে আবার অন্য একজনের আছে শত্রুতা। মূলতঃ সে জালিম। এখন যদি অপর বন্ধুর এরূপ ভয় হয় যে, যায়েদ আমার বন্ধু এ খবর উক্ত জালিম লোকটি জানতে পারলে আমাকে অপমান বা কতল করবে, তাহলে এ ক্ষেত্রে সে বন্ধুত্বকে গোপন বা অস্বীকার করতে পারে। এভাবে যদি আশংকা করে যে, সে আমার মালের খবর জানতে পারলে তা ছিনিয়ে নিবে, তাহলে সে বলতে পারে যে, আমার নিকট মাল নেই।

(২) নিজ পাপ গোপন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা জায়েয, বরং ওয়াজিব। কেননা পাপের কথা প্রকাশ করা নাজায়েয। যেমন কেউ যিনায় লিপ্ত হয়ে পড়ল। কেউ তার নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে তা অস্বীকার করবে। পাপ প্রকাশ করা আরেক পাপ। এ মর্মে ইমাম হাকেম (রঃ) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলে করীম (সাঃ) ফরমায়েছেন তোমরা ঐ সমৃদয় কাজ হতে বিরত থাক যা আল্লাহপাক নিষেধ করেছেন। আর যদি কারো থেকে কোন পাপ ঘটে যায় তাহলে আল্লাহর পর্দা দ্বারা তা গোপন করবে।

(৩) দু'জন মুসলমানের মধ্যে সন্ধি করানোর নিমিত্তে মিথ্যা বলা জায়েয। যেমন দু'ব্যক্তির মাঝে পরস্পরে দ্বন্দ্ব আছে। তাদের একজনের নিকট যেয়ে যদি বলা হয়- বাস্তবিকই আপনি তাকে যেমনই মনে করুন না কেন সে কিন্তু আমার নিকট আপনার বেশ প্রশংসা করেছে ও নিজ দোষ স্বীকার করেছে। এভাবে যে ধরনের কথা বলার দ্বারা তার মন এর প্রতি সন্তুষ্ট হয় সে ধরনের কথা বলা জায়েয। এরূপে অন্যজনের নিকট যেয়েও আলাপ করল যাতে সেও এর প্রতি খুশী হয়ে যায় এবং পরস্পরের মনের ক্ষোভ কেটে যায়। অথচ বাস্তবে সে তার প্রশংসা না করে বরং আরো কটুক্তি করে তথাপি তা দোষণীয় নয়। বরং সৎ উদ্দেশ্যের কারণে সে সওয়াবের অধিকারী হবে। কথিত আছে

"دروغ مصلحت امـیـز بـه از راستی فتنه انگیز "


“কলহ সৃষ্টিকারী সত্য হতে মঙ্গলজনক মিথ্যা উত্তম।”

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে উল্লেখ আছে যে, রাসূলে মাকবূল (সাঃ) ফরমায়েছেন- যে ব্যক্তি মানুষের মাঝে সন্ধি স্থাপনের মানসে উত্তম কথা বলে ও (অন্যের প্রতি) উত্তম কথার সম্বন্ধ করে সে মিথ্যাবাদী নয় ।

(৪) যুদ্ধের মধ্যে শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে প্রতারণামূলক কথা বলা জায়েয। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে- নবী করীম (সাঃ) ফরমায়েছেন- "যুদ্ধের অপর নাম প্রতারণা" (মেশকাত-কিতাল অধ্যায়)

এখানে প্রতারণা দ্বারা এমন মিথ্যা বা ধোকা উদ্দেশ্য যা দ্বারা শত্রুবাহিনীকে প্যাচে ফেলে তাদের উপর জয়লাভ করা যায়। যেমন- যুদ্ধ চলাকালে একজন শত্রুকে লক্ষ্য করে বলা হল- ঐ যে একজন অশ্বারোহী আসছে। এতে সে ঐদিকে তাকাল। আর সাথে সাথে তার উপর আঘাত হেনে সরে পড়ল। এটা জায়েয। তবে চুক্তি ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নাজায়েয। যেমন শত্রুপক্ষের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হলো যে, চার মাসের মধ্যে কেউ কারো উপর আক্রমণ করবে না। এখন ঐ সময় পার না হওয়া পর্যন্ত হামলা করা জায়েয হবে না।

(৫) স্ত্রীকে খুশী করার লক্ষে স্বামীর জন্য ও স্বামীকে খুশী করার লক্ষে স্ত্রীর জন্য মিথ্যা বলা জায়েয। মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসূলে করীম (সাঃ) তিন ব্যাপারে মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছেন- (ক) বিবাদমান মানুষের মাঝে সন্ধি স্থাপনের লক্ষে (খ) যুদ্ধ চলাকালে ও (গ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে একে অন্যকে খুশী করার লক্ষে। যেমন কারো স্ত্রী কোন জিনিষ বা অলংকার নেয়ার জন্য স্বামীর নিকট পীড়াপীড়ি করল। স্বামী স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষে তার আবদার পূর্ণ করার ওয়াদা করল সত্য; কিন্তু তার অন্তরে তা পালনের খেয়াল নেই । এক্ষেত্রে সে গোনাহগার হবে না। এভাবে একে অন্যকে খুশী করার জন্যে বাহ্যিক ভাবে অতি মাত্রায় মহব্বত ও ভালবাসার ছলনা করল। অথচ প্রকৃতপক্ষে অন্তরে সে পর্যায়ের মহব্বত নেই। এ ক্ষেত্রেও তারা গোনাহগার হবে না। বরং এটা জায়েয।

মাসআলা : ছেলে-মেয়েকে ভাল কাজের জন্যে উৎসাহিত করার লক্ষে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া জায়েয। যেমন কেউ বলল "তুমি মাদ্রাসায় যাও! তুমি ফিরে আসলে তোমাকে একটি মজার জিনিষ দেখাব বা অমুক জিনিষ দিব" এতে সে গোনাহগার হবে না ।

ফায়েদা : মিথ্যা বলা জায়েয হওয়া প্রসঙ্গে ইমাম গাযযালী (রঃ) উপরোক্ত কতিপয় ক্ষেত্র উল্লেখ করেছেন এবং পরিশেষে লিখেছেন

মিথ্যার আশ্রয় নিলে এতটুকু ক্ষতি তো অবশ্যই হয় যে, শ্রবণকারী একটি ভ্রান্ত বিষয়কে মনের মধ্যে স্থান দেয়। সুতরাং যে ক্ষেত্রে সত্য বলার দ্বারা এর চেয়ে মারাত্মক কোন ক্ষতির প্রকট আশংকা হয় সে ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে। যেমন সত্য বলার দ্বারা যদি কারো জান-মাল বিনষ্টের তিব্র আশংকা দেখা দেয় সেক্ষেত্রে সত্য কথা বলা জায়েয নেই । এরূপে সে ক্ষেত্রে মিথ্যার দ্বারা যে ক্ষতি হয় উপকারের তুলনায় তা অতি নগন্য সেক্ষেত্রেও মিথ্যা বলা জায়েয। দু'জনের মাঝে সন্ধি স্থাপন ও শত্রুকে পরান্ত করার জন্যে মিথ্যা বলা জায়েয হওয়ার এটাই কারণ। তদ্রূপ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক হৃদ্যতা ও ভালবাসা থাকা অতীব জরুরী। অন্যথায় দ্বীনি ব্যাপারেও বহু ক্ষতির আশংকা থাকে। তাই এ স্বার্থে মিথ্যা বেলা জায়েয।

বলা বাহুল্য যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যের দ্বারা উদ্দেশ্য হাছিল হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মিথ্যা বলবে না। কেননা প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা জায়েয। সর্বক্ষেত্রে বা সামান্য জরুরতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া নাজায়েয। কেননা মিথ্যা বলার অভ্যাস হয়ে গেলে যেখানে মিথ্যার অনুমতি নেই সেখানেও মিথ্যা বলে বসবে। যে সব ক্ষেত্রে মিথ্যার অনুমতি দেয়া হয়েছে সে সব ক্ষেত্রেও পারতপক্ষে মিথ্যা বলবেনা বরং প্রয়োজনের তাগিদে নিজ অন্তরে সঠিক খেয়াল রেখে বাহ্যিক ভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া তথা ইঙ্গিতে ও প্যাচের মাধ্যমে কথা বলাই উত্তম। যেমনটি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) করেছিলেন। জালিম বাদশাহ যখন তাঁর স্ত্রী সারাকে বে-ইয্যত করতে চেয়েছিলেন, তাকে তিনি নিজ বোন বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রী। কিন্তু বোন হিসেবে পরিচয় দিলেও তা একেবারে মিথ্যে নয়। কেননা সকলেই এক আদি মাতা-পিতার সন্তান। সে হিসেবে পরস্পরে ভাই-বোন হতে পারে। তদ্রূপ তাঁর বংশের সকলে যখন মেলায়/পূজায় যাচ্ছিল, তিনিও কিছুদূর তাদের সাথী হয়েছিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর উপরে নক্ষত্ররাজির দিকে তাকিয়ে বললেন “দেখ আমি অসুস্থ। আমি যেতে পারব না।" তিনি ফিরে এসে তাদের সমস্ত মূর্তি ভেঙ্গে বড়টির কাঁধে কুঠার ঝুলিয়ে রাখলেন। গোত্রের লোক ফিরে এসে এ কান্ড দেখল। তারা চিন্তা-ভাবনার পর স্থির করল যে, ইব্রাহিম-ই এ কাজ করেছে। ক্রুদ্ধ জনতার সম্মুখে তাকে উপস্থিত করে জিজ্ঞেস করা হল- ইব্রাহিম! সত্য বল এ অপকর্ম কে করেছে? তিনি উত্তর দিলেন-"তাদের বড়ই এ কাজ করেছে।” তিনি নিজের নাম প্রকাশ করলেন না। তারা বুঝল সে করেনি বরং বড় মূর্তিটিই ছোটদের উপর গোস্বা করে এ কীর্তি ঘটিয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কথার প্রকৃত অর্থ নিজেকে বুঝান। কেননা তিনি অবশ্যই মূর্তিগুলির চেয়ে সর্বক্ষেত্রে উর্ধ্বে ও উচ্চে। কিন্তু কথার প্যাঁচে তারা তা বুঝতে সক্ষম হয়নি। তদ্রূপ প্রথমাংশে। "আমি অসুস্থ” শারীরিক ভাবে তিনি সুস্থ বটে; কিন্তু তাদের শিরক ও পূজার কীর্তি দেখে তিনি আন্তরিকভাবে মর্মাহত ও পীড়িত ছিলেন। সুতরাং তাঁর উদ্দেশ্য ও নিয়তের প্রতি লক্ষ রেখে তিনি সত্যই বলেছেন। যদিও শ্রোতারা তা বুঝতে সক্ষম হয়নি।

মোদ্দা কথা হল জান, মাল ও ইয্যত-আবরু বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ জরুরত বশতঃ দ্বিমুখী কথার সাহায্য নেয়া জায়েয। (অনুবাদক)

ফায়েদা : (১) সর্বাপেক্ষা মারাত্মক মিথ্যা হল মিথ্যা মাসআলা তৈরী করা, মিথ্যা কাশফ ও এলহামের সাহায্যে মিথ্যা কোন সংবাদ প্রকাশ করা, বা মিথ্যা হাদীস রচনা করা। সহিহ বুখারীতে এসেছে, রাসূলে করীম (সাঃ) ফরমায়েছেন- যে কেউ আমার প্রতি এমন কোন মিথ্যা বিষয়ের সম্বন্ধ করবে যা আমি বলিনি সে তার ঠিকানা জাহান্নামে বুঝে নিক। (মুসলিম)

(২) মিথ্যা স্বপ্নের কথা প্রকাশ করা কঠোর গোনাহ। বুখারীতে এসেছে- মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “চরম মিথ্যাসমূহের মধ্য হতে এটাও একটা যে, মানুষ নিজ চোখে যা দেখেনি তা সে স্বচক্ষে দেখেছে বলে ব্যক্ত করে।"

সহীহ বুখারীর অন্য একটি হাদীসে আছে “যে ব্যক্তি মিথ্যা স্বপ্ন বানায় তাকে কিয়ামতের দিবসে যবের মধ্যে গিরা দেয়ার শাস্তি দেয়া হবে। অর্থাৎ যেহেতু এটা একটা অসম্ভব কাজ, তাই তার অসম্ভব ও অবাস্তব স্বপ্ন প্রকাশের জন্য তাকে সাজা ভোগ করতে হবে।

(৩) মিথ্যা দাবী পেশ করা। (মিথ্যা মামলা দায়ের করা) মারাত্মক পাপ। সহীহ মুসলিমে এ মর্মে উল্লেখ আছে- রাসূলে করীম (সাঃ) ফরমায়েছেন- যে ব্যক্তি এমন বিষয় বা বস্তুর দাবী করে যাতে তার কোন হক/অধিকার নেই। সে আমার দলভূক্ত নয় । সে দোযখে তার ঠিকানা গড়ে নিক। (মিশকাত-কিতাবুল কাযা অধ্যায়)

(৪) মিথ্যা রূপে নিজেকে উচ্চ কোন বংশের দাবী করাও বড় গোনাহ। যেমন শেখ বংশের কেউ সায়েদ বংশের দাবী করল বা জোলা-তাতী বংশের কেউ শেখ বংশের দাবী করল ইত্যাদি। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে উল্লেখ আছে যে, রাসূলে পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি জেনে-শুনে নিজ পিতা ছাড়া অন্য কাউকে তার পিতা হওয়ার দাবী করবে তার জন্যে বেহেশত হারাম"।

(৫) সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় রাসূলে পাক (সাঃ) ফরমায়েছেন মানুষ মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য যে কোন শোনা কথা অন্যের নিকট প্রকাশ করা যথেষ্ট। সুতরাং কোন কথা বা সংবাদ শুনলে তা কতটুকু সঠিক আগে তা যাঁচাই করবে। যাঁচাইয়ের মাধ্যমে তা সঠিক ও যথার্থ প্রমাণিত হলে অন্যের নিকট প্রকাশ করতে পারে। (যদি না তাতে কোন কলহ ফেনার ভয় থাকে।) অন্যথায় সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url