সফরের দূরত্বের পরিমাণ নির্ধারণ আহকাম ও মাসায়েল।
সফরের দূরত্বের পরিমাণ নির্ধারণ
হানাফী মাজহাবের জাহেরে রেওয়ায়াত অনুযায়ী, সাধারণ শক্তি ও সামর্থ্যের মানুষ পায়ে হেটে মধ্যম চলনে তিন দিনে যে পরিমাণ রাস্তা অতিক্রম করতে পারে, ঐ পরিমাণ দূরত্বটাই সফরের দূরত্ব হিসেবে ধর্তব্য। অনুরূপভাবে মধ্যম ধরণের উটের স্বাভাবিক চলনে তিন দিনে যে পরিমাণ “রাস্তা অতিক্রম করে, ঐ পরিমান দূরত্বটা সফরের দূরত্ব হিসেবে স্বীকৃত।
হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ মাশাইখগণ তিন দিনে অতিক্রম করা যায়। মত দূরত্বকে শরঈ সফরের দূরত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং মাইল-কিলোমিটার ইত্যাদি দ্বারা দূরত্ব নির্ধারণ করাটা গ্রহণ যোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন। হিদায়া গ্রন্থের সুখ্যাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনুল হুমাম (রহ.) এর কারণ হিসেবে বলেন, তিন দিন তিন রাতের দূরত্ব, যা হানাফী মাজহাবের মূল বক্তব্য, তা রাস্তা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। রাস্তা সুগম হলে তিন দিনে যে পরিমাণ পথ অতিক্রম করা যাবে, রাস্তা দূর্গম হলে তার চেয়ে অনেক কম পথ অতিক্রম সম্ভব হবে। ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনাও অনুরূপ। রাস্তা ভেদে দূরত্বকে বিবেচনায় আনা হয়েছে। মাইল ইত্যাদি দ্বারা দূরত্ব নির্ধারিত হলে যেহেতু রাস্তাভেদে দূরত্বের বিষয় উপেক্ষিত হয়, ফলে শরীয়তের উদ্দেশ্যও বিঘ্নিত হয়, তাই মাইল ইত্যাদির মাধ্যমে সফরের দূরত্ব নির্ধারণ করা সমীচিন নয় ।
-ফাতহুল কাদীর-২/২৯, জাওয়াহেরুল ফেকহ-১/৪৩৬
তবে হানাফী মাজহাবের কতিপয় মাশাইখ অবশ্য মাইল, ফরসখ, মারহালা ইত্যাদি গাণিতিক হিসেবে সফরের দূরত্ব নির্ধারণ করেছেন। রাস্তা-ঘাট সুগম হলে ও সমপর্যায়ের পথ হলে সেখানে চলার সুবিধাদি যদি প্রায় একই ধরণের হয়, তাহলে গাণিতিকভাবে দূরত্ব নির্ধারণ করলে তাতে কোন অসুবিধা নেই। প্রথমোক্ত অবস্থায় শরঈ অসুবিধার যে আশংকা ব্যক্ত হয়েছে, তাও এখানে বিদ্যমান নয় । তাই উপমহাদেশের হানাফী আলেমগণ এ সকল দেশের রাস্তা ঘাটের সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় শেষোক্ত (গাণিতিক পরিমাপে সফরের দূরত্ব নির্ধারণ করার) মতটি গ্রহণ করেছেন ।
দৈর্ঘ্য মাপার যে মাপকাঠি রয়েছে, তাতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, তাই একেক মাপকাঠির আলোকে সফরের দূরত্বের ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপ ফেকহের কিতাবে উদ্ধৃত রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মতানুসারে ওলামায়ে কেরাম ৪৮ ইংরেজী মাইলকেই সফরের দূরত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিলোমিটার হিসেবে তা ৭৭.২৫ (সোয়া সাতাত্তর) কিলোমিটার প্রায়।
(ফাতওয়ায়ে রাশিদিয়া-৪২৩, জাওয়াহেরুল ফেকহ-১/৪৩৭)
আহকাম ও মাসায়েল
স্থলপথে শরঈ মুসাফির (অর্থাৎ যার ক্ষেত্রে মুসাফিরের বিশেষ হুকুম-আহকাম ও মাসায়েল প্রযোজ্য) ঐ সকল মুসাফিরকে বলা হয়, যারা এমন দূরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সফর শুরু করেছে, যেখানে পৌঁছতে স্বাভাবিক চলায় পায়ে হেঁটে তিন দিন সময় লাগে । চাই ঐ গন্তব্যে দ্রুতগামী কোন যানবাহন দ্বারা এক দু'ঘন্টা বা তার চেয়ে কম সময়ে পৌঁছতে পারা যাক না কেন। শরঈ মাইলের পরিমাপে তা আটচল্লিশ মাইল হওয়া বাঞ্চনীয়। বর্তমানের কিলোমিটারের মাপে তা ৭৭.২৫ সোয়া সাতাত্তর কিলোমিটার। সুতরাং বর্তমান হিসাবে শরঈ মুসাফির বলে গণ্য হতে হলে সড়ক পথে কেউ ৭৭.২৫ কিলোমিটারের দূরত্বের গন্তব্যের উদ্দেশ্য বের হতে হবে। সফরের শুরুতে পূর্ণ ৭৭.২৫ কিলোমিটার দূরত্বের নিয়ত করে বের হতে হবে। যদি এমন হয় যে প্রথমে ৮ বা ১০ কিলোমিটারের দূরত্বে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে সেখানে যাওয়ার পর নিজ বাড়ী থেকে ৭৭.২৫ কিলোমিটারের দূরত্বে যাওয়ার নিয়ত করল, তাহলে তার এসফর শরঈ সফর হিসবে গণ্য হবে না। কসর ইত্যাদি সফরের আহকাম ও প্রযোজ্য হবে না। এমন কি কেউ যদি নিয়ত করার সময় এক বারে ৭৭.২৫ কিলোমিটারের দূরত্বের সফরের নিয়ত না করে কেবল কিছু কিছু করে সফর করতে থাকে, আর এভাবে তার ৭৭.২৫ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশী পথ অতিক্রান্ত হয়, তাহলেও সে শরঈ মুসাফিরের হিসেবে গণ্য হবে না।
অনুরূপভাবে শুধু ৭৭.২৫ কিলোমিটারের সফরের নিয়ত করলেই হবে না, বরং শরঈ মুসাফির হতে হলে তাকে এ উদ্দেশ্যে নিজ বাড়ী, তৎসংলগ্ন জনবসতি থেকে বের হতে হবে। তাহলে বুঝা গেল, শরঈ মুসাফির হিসেবে গণ্য হতে হলে ৩টি শর্ত রয়েছে:
১. ৭৭.২৫ কিলোমিটার বা তার অধিক দূরত্বের সফরের নিয়ত করা।
২. সফরের শুরু থেকে ৭৭.২৫ কিলোমিটার বা তার অধিক সফরের নিয়ত করা ।
৩. সফরের নিয়ত করে নিজ আবাস স্থল ও তৎ সংলগ্ন জনপদ থেকে বের হওয়া। -বাদায়ে উসানায়ে ১/২৬১, ২৬৩ ২৬৪
সুতরাং কারো মাঝে যদি উপরোক্ত শর্ত ত্রয় যথাযথ ভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়, তাহলে সে শরঈ মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। বাস ষ্টেশন, রেল ষ্টেশন, বিমান বন্দর ইত্যাদি যদি নিজ জনবসতির অন্তর্গত হয়, তাহলে ষ্টেশন সংলগ্ন বসতি ছাড়ার পর সে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি ষ্টেশন জনবসতির বাইরে হয়, তাহলে ষ্টেশনে সে মুসাফির হিসাবে গণ্য হবে।