আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পরিচয়
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বলা হয় এমন সত্যপন্থি দলকে যারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন ও রাসুলের সুন্নত ও সকল সাহাবীদের রীতিনীতি অনুসরণ করে চলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ভবিষ্যত বাণীতে বলেছিলেন যে, আমার উম্মতের মধ্যেও বনি-ইসরাঈলের ন্যায় বিভক্তি আসবে। বনী-ইসরাঈল ৭২ দলে বিভক্ত ছিল, আর আমার উম্মত হবে ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। তম্মধ্যে একটি দলই নাজাত প্রাপ্ত হবে। এই দলটির পরিচয় দিতে গিয়ে রাসূল সা. বলেন, তারা ঐ সকল লোক যারা আকীদার ক্ষেত্রে আমি ও আমার সাহাবাদের রীতিনীতির অনুসরণ করবে। (তিরমিযী) নিম্মে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কিছু সহী আকীদা পেশ করা হল।
১. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আকীদা-
আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। (আল-কুরআন)
আল্লাহর সাদৃশ্য কোন কিছু নেই এবং তিনি অক্ষম নন। (আল-কুরআন)
আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। (আল-কুরআন)
আল্লাহ তায়ালা অনাদি ও অনন্ত। (আল-কুরআন)
আল্লাহ তায়ালা অক্ষয়। তাঁর কোন ধ্বংস নেই। (আল-কুরআন)
মানুষের ধ্যান-ধারণা আল্লাহ তায়ালাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। (আল-কুরআন)
আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা। (আল-কুরআন)
২. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আল্লাহর দর্শন সম্পর্কে আক্বীদা-
জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার দর্শন লাভ সত্য। এতে কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা ও ধরণ থাকবে না। (সূরা কিয়ামা, বুখারী-মুসলিম)
৩. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নবী মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে আক্বীদা-
মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ তায়ালার নবী ও রাসুল। (সুরা ফাতাহ -২৯, আলে ইমরান-১৪৪)
মুহাম্মাদ সা. সর্বশেষ নবী ও নবীদের সরদার। (সুরা আহযাব-৬০, বুখারী)
মুহাম্মাদ সা. সকল সৃষ্টির নবী। (সুরা সাবা-২৮, আ'রাফ-১৫)
৪. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আল-কুরআন সম্পর্কে আকীদা-
নিশ্চয় কুরআন আল্লাহর কালাম। (সূরা তাওবা)
আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। (সূরা আযযুমার-১, আল-মুমিন-২)
পবিত্র কুরআন সকল সন্দেহ থেকে মুক্ত। (সূরা বাকারা-১)
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনকে তাঁর নবী মুহাম্মাদ সা. এর উপর ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ করেছেন। (সূরা ইউসুফ ৩, শুআরা ১৯৩)
৫. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মি'রাজ সম্পর্কে আকীদা-
মি'রাজ সত্য। রাসুল সা. কে রাতের বেলায় মসজিদে আক্বসায় ভ্রমণ করানো হয়েছে। এবং তাকে জাগ্রতাবস্থায় স্বশরীরে নভোমন্ডলে উঠানো হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা যেখানে চেয়েছেন সেখানেই নিয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা নবী করীম সা.-কে যে জিনিস দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন তা দিয়েই সম্মানিত করেছেন এবং যা ওহী করার ইচ্ছা তাই ওহী করেছেন। (সূরা-বনী ইসরাঈল, সূরা নাজম)
৬. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের লাওহে মাহফুজ ও কলম সম্পর্কে আকীদা-
লওহে মাহফুজ সত্য। লওহে মাহফুজ ঐ সংরক্ষিত ফলককে বলে যাতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের ভাগ্য ও কিয়ামত পর্যন্ত সকল ঘটমান বিষয় লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। (সূরা বুরূজ- ২১, ২২)
আহলে সুন্নত ওয়াল জামা'আত “কলম' ও তার সকল লিখনির উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেন (সুরা আম্বিয়া- ৯৪, কলম-১, তিরমিযী)
৭. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আরশ, কুরসী, পুলসিরাত সম্পর্কে আক্বীদা-
আরশ ও কুরসী চিরসত্য। (সূরা মুমিন)
"আরশ" রাজ সিংহাসনকে বলা হয় এবং "কুরসী" সিংহাসনকে বলা হয়।
আল্লাহর আরশ-কুরসী কী, ফেরেশতারা একে কীভাবে বহন করছে- এসব প্রশ্নের সমাধান মানুষের আকল-বুদ্ধি দিতে পারবে না। তাই এ সম্পর্কে নির্মল পরিস্কার ও বিশুদ্ধ মাযহাব সাহাবি ও তাবেইনদের থেকে এরুপ বর্ণিত হয়েছে "মানব জ্ঞান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর স্বরুপ পূর্ণরুপে বুঝতে অক্ষম"।
“পুলসিরাত” সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা'আত এই কথার উপর ঈমান রাখে যে, জাহান্নামের উপর বিস্তৃত একান্ত তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ণ এক পুল নির্মাণ করা হবে। (সূরা মারইয়াম)
৮. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আকীদা-
সকল সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভালোবাসা রাখা, ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাদের কাউকে নিয়ে কোন বাড়াবাড়ী না করা, কারো ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ না করা, আকাশের ধ্রুব তারকা সদৃশ। তারা
তাঁরা উম্মতের জন্যে আমানত। (মুসলিম)
তাঁরা রাসূলের অতি প্রিয়। (তিরমিযী)
তাঁরা বিশেষভাবে নির্বাচিত। (আবু দাউদ)
তাঁরা বেহেস্তের সুসংবাদ প্রাপ্ত। (তিরমিযী)
তাঁরা ঈমানে দৃঢ়। (আল- -কুরআন)
তাঁরা একে অপরের প্রতি অনুগ্রহশীল। (সূরা ফাতাহ-২৯)
তাঁরা কুফরীর মোকাবেলায় আপসহীন। (সূরা ফাতাহ-২৯) তাঁরা ছিলেন তাহাজ্জুদ গুজার। (সূরা ফাতাহ-২৯)
তাঁদের চেহারায় ইবাদাতের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। (সূরা ফাতাহ-২৯)
তাঁরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনাকারী। (সুরা ফাতাহ-২৯)
তাঁরা রাসূলের পূর্ণ অনুসারী। (সূরা নুর)
তাঁরা হাদিসের আমানতদার। (তিরমিযী)
সকল সাহাবিই জান্নাতী। (সূরা নিসা।
তাঁরা সত্যের মাপকাঠি। (বাকারা-১৩, আবু দাউদ)
৯. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আল্লাহর ওলীগণ ও মাযার সম্পর্কে আক্বীদা-
ওলি-আওলিয়াগণ আল্লাহর একনিষ্ঠ ও খাটি বান্দা এবং তাদের থেকে প্রকাশিত কারামত সত্য যা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তাওয়াতুরের পদ্ধতিতে নকল হয়ে আসছে। এই গুলো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যেমন: পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে- হযরত সুলাইমান আ. এর এক সাহাবী আসিফ বরখিয়া চোখের পলকের মধ্যে বিলকিস রাণীর সিংহাসন এক মাসের দুরত্ব থেকে সুলাইমান আ. এর কাছে পৌঁছিয়ে ছিলেন। (সূরা নামল -৪০)
এমনিভাবে হযরত উমর রা. এর চিঠির মাধ্যমে নীল নদে পানি প্রবাহিত হওয়ার ঘটনা ইত্যাদি।
“মাযার” শব্দের অর্থ: যিয়ারতের স্থান, সাধারণভাবে বুযুর্গদের কবর যেখানে যিয়ারত করা হয় তাকে মায়ার বলা হয়। সাধারণত: কবর যিয়ারত দ্বারা বেশ কিছু ফায়দা হয়। যেমন: কলব নরম হয়। মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়, আখেরাতের চিন্তা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। বিশেষভাবে বুযুর্গদের কবর যিয়ারত করলে রুহানী ফয়যও লাভ হয় । মাযারের এতটুকু ফায়দা অনস্বীকার্য।
কিন্তু এর অতিরিক্ত সাধারণ মানুষ মাযার ও মাযার যিয়ারত সম্পর্কে এমন কিছু গলত ও ভ্রান্ত আক্বিদা রাখে যার অনেকটা শিরকের পর্যায়ভুক্ত। সেগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য। (আহকামে যিন্দেগী)
১০. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের গনক, জ্যোতিষি সম্পর্কে আকীদা-
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআ'ত গনক, জ্যোতিষিকে বিশ্বাস করেন না এবং ঐ ব্যক্তিকেও বিশ্বাস করেন না যে কুরআন-সুন্নাহ এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমতের পরিপন্থি কোন কিছুর দাবি করে। (নামল-৬৫, মুসলিম)
গণক বা জ্যোতিষির কাছে যাওয়া ও তাদের কাছে ভবিষ্যৎ জানতে চাওয়া ও তাদের কথা বিশ্বাস করা হারাম ও কবীরা গুনাহ। এরূপ করলে তার চল্লিশ দিনের নামায কবুল হবেনা। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
১১. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের তাবীজ ও ঝাড় ফুঁক সম্পর্কে আকীদা-
তাবীজ ও ঝাড় ফুঁকে কাজ হওয়াটা নিশ্চিত নয়। হতেও পারে, নাও হতে পারে। তাবীজ ও ঝাড় ফুঁক কুরআন ও হাদীসের বাক্যাবলীর দ্বারা বৈধ উদ্দেশ্যে করা হলে তা জায়েয। পক্ষান্তরে কোন কুফর-শিরকের কথা থাকলে বা এরূপ কোন যাদু হলে তা দ্বারা তাবীজ ও ঝাড় ফুঁক হারাম। এমনিভাবে যেসব বাক্য বা শব্দ কিংবা নকশা যার অর্থ জানা যায় না তা দ্বারাও তাবীজ বৈধ নয়। তাবীজ বা ঝাড় ফুঁকের জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন বা সময় বা কারো ইজাযত জরুরী মনে করা ঠিক নয়। (আল-মাজমু', কুরতুবী, আল ফাতাহ)
সংক্ষেপে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আরো কয়েকটি আক্বীদা-
=>আবু বকর রা.-কে উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি মনে করা।
=>রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই জামাতা উসমান রা. ও আলী রা. কে সম্মান করা।
=>জান্নাত-জাহান্নাম বর্তমানে বিদ্যমান ।
=>কিয়ামতের পূর্বে মুসলমানদের খলিফা হয়ে হযরত ইমাম মাহদি আগমন করবেন।
=>হযরত ঈসা আ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হয়ে কিয়ামতের পূর্বে আগমন করবেন।
=>কিয়ামতের পূর্বে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।
=>দাজ্জালের ফিতনার পর ইয়াজুয-মাজুযের ফিতনা আসবে।
=>হাশরের মাঠে মানুষের নেক ও বদ আমল মাপার জন্য আল্লাহপাক মীযান অর্থাৎ দাড়িপাল্লা স্থাপন করবেন।
=>পাপাচারী মুমিন তার বদ আমল পরিমান শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহর দয়ায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।
=>রাসূল স. হাশরের মাঠে মুমিনকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য শাফাআত বা সুপারিশ করবেন। এছাড়াও রোজা, কোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি বিশেষ আমলকে, হাফেযে কোরআনকে এবং জান্নাতী নেককার মুমিনকে পাপাচারী জাহান্নামী মুমিনদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি প্রদান করা হবে।
আকীদাসমূহ,আহলে সুন্নাত