হাদীস প্রচারে নারীর ভূমিকা।


হাদীসের পরিচয়

শাব্দিক অর্থে حديث মানে নতুন, প্রাচীন ও পুরাতন এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যেসব কথা ও কাজ পূর্বে ছিলো না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে । তাই হাদীসের আরেক অর্থ হলো কথা।


হাদীসের অপর নাম سنة

সুন্নাত শব্দের অর্থ : চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি । যে পন্থা ও রীতি আল্লাহর রাসূল (স) অবলম্বন করতেন, তাকে সুন্নত বলা হয়।


পরিভাষায় হাদীস বলা হয়


ما اضيف الى النبي صلى الله عليه وسلم من قول او فعل او ذقرير أو صفة حذى الحركاذ والسكناذ في اليقظة والمنام -

অর্থ : রাসূলের কথা, কাজ মৌন সমর্থন,তার গুণাবলী এমনকি নিদ্রা ও জাগরণের যাবতীয় আচার আচরণকে হাদীস বলা হয়


আর রাসূল এমন সত্তা যিনি সৃষ্টি না হলে আমরা সৃষ্টি হতামনা হতো না জগৎ সৃষ্টি! সুতরাং তার বাণী বা কথা যে কি পরিমান গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার দাবী রাখে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

নিঃসন্দেহে গুরুত্ব ও মর্যাদার দিক দিয়ে হাদীসের স্থান দ্বিতীয় পর্যায়ের। কারণ কালামুল্লাহ হলো প্রথম পর্যায়ের। আর হাদীস এমন এক ইলম যা ইলমে দ্বীনের অন্যতম উৎস ও কোরআনুল কারীমের ব্যাখ্যা। শরীয়তের ইলম সমূহের অগ্রভাগ ও চাবি, শ্রুতিমূলক দলীল সমূহের চেরাগদান ও বাতি, সুনিশ্চিত পথ সমূহের খুঁটি, ইসলামের বিধি-বিধানের ভিত্তি ও স্তম্ভ। সমস্ত ফিকহী বর্ণনা সমূহের প্রমাণ, ছোট বড় দ্বীনি সকল বিষয়ের উৎস। যাবতীয় আক্বীদা বিশ্বাসের নিয়ম নীতি সকল লেনদেনের কেন্দ্র আর সেই ইলমে হাদীস যদি না থাকতো তাহলে সে যা চাইত তাই বলতো ধর্মের ব্যপারে। সুতরাং যারা ইলমে হাদীসের ধারক বাহক হবে তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদার ব্যাপারেও অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে।


হাদীসের প্রচারে নারী জাতি

পৃথীবিতে মানব সৃষ্টির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো ইবাদত বা আল্লাহর আনুগত্য প্রদর্শন । এই অভীষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ইবাদতের রীতি নীতিকে জ্ঞাত করতে এবং অন্যায় অপরাধ সম্পর্কে অবহিত করতে যুগে যুগে করুণাময় প্রভু অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন।

সেই ধারায় সর্বশ্রেষ্ট সর্বশেষ নবী হলেন সারওয়ারে কায়েনাত, শাফিউল মুজনিবীন, রাসূলে আরাবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স) । যার মাধ্যমে আমরা উম্মতে মুহাম্মাদী সঠিক পথের দিশা পেয়েছি । যিনি দয়াময় প্রভুর বাণী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এবং এর মাধ্যমে সঠিক পথ অবলম্বন শিখিয়েছেন । সুতরাং যেই বিষয়ে কোরআনে কিছু বলা হয়নি বা সংক্ষেপে বলা হয়েছে । অথবা মর্মার্থ বুঝানো হয়নি তিনি সেগুলো হাদীসের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে গেছেন।

যা সাহাবায়ে কেরামদের তাঁদের যুগ পর্যন্ত প্রচার করেছেন। এক যুগের মানব অন্য যুগের মানব পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই হাদীসের প্রচার প্রসার ঘটে। যেভাবে পুরুষ সাহাবীরা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সেভাবে কিছু নারী সাহাবীরাও কোন অংশে পিছিয়ে ছিলেন না।

যুগে যুগে বিপ্লবী চেতনাশীল নারীদের সামাজিক অবদান ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জল হয়ে আছে। এমন অসংখ্য বিপ্লবী নারীদের নমুনা রয়েছে যাদের কল্যাণে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল ইসলামী মারকায ও ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র । তারা নিজেরাই ছিলেন কোরআন ও সুন্নাহর ফকীহা এবং ইলমে দ্বীনের ধারক বাহক।


হাদীস প্রচারে উম্মাহাতুল মুমিনীনদের ভূমিকা

হাদীস প্রচারে নবী পত্নীগণের ভূমিকা ছিলো অনস্বীকার্য। এদের কেউ কারো অপেক্ষা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। রাসূল (স)-এর ১১ জন পত্নীর মধ্য হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন ৯ জন।
এদের মাঝে-
১. হযরত আয়েশা (রা) । তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২২১০
২. উম্মে সালামা (রা) । তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৩৭৮।
৩. উম্মে হাবীবা (রা) তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৬৫
৪. হাফসা (রা) তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৬০।
৫. মায়মুনা (রা) । তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪৬।
৬. হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রা) তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১১।
৭. হযরত সাওদা (রা) তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫।

এছাড়াও হযরত জুয়াইরিয়া ও সাফিয়্যা (রা) এদের থেকেও হাদীস বর্ণনার বিষয়টি প্রমাণীত।
হাদীস প্রচারে অন্যান্য সাহাবিয়্যাদের ভূমিকা
অন্যান্য সাহাবীয়ারাও হেরার এ প্রদীপ্ত শিখা পৌঁছাতে কোন ত্রুটি করেননি।
এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন
১. আসমা বিনতে আবু বকর।
২. রুবাইয়ো বিনতে মুআওয়াজ ইবনে আফরা।
৩. উম্মে হানী।
৪. উম্মে আইমান।
৫. আসমা বিনতে ইয়াজিদ।
৬. আসমা বিনতে উমাইস।
৯. উম্মে সুলাইম।
১০. উম্মে ফযল লুবাবা।
১১. যয়নব বিনতে আবু সালামা।
১২. হামনা বিনতে জাহাশ।
১৩. উম্মে দারদা।
১৪. বুসরা।
১৫. উম্মে আতিয়্যা।
১৬. উম্মে উমারা (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আলাইহিন্না আজমায়ীন)

-তথ্যসূত্র: হায়াতুস মাহাবিয়্যাত


হাদীস প্রচারে তাবেয়িয়্যাহদের ভূমিকা
মহিলা সাহাবিয়্যাগণ যেভাবে হাদীসের প্রচার প্রসার করে গেছেন, তেমনিভাবে মহিলা তাবেয়ীগণও আমৃত্যু পর্যন্ত হাদীস বর্ণনা করে গেছেন । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-
১. হাফসা বিনতে সিরীন (র)
২. আমরা বিনতে আব্দুর রহমান (র)
৩. মোয়াজাহ আদাবিয়্যাহ (র)
8. উম্মে আসিম (র)
৫. কাবশা বিনতে কাআব (র)

-তথ্যসূত্র: মেছালী খাওয়াতীন।


শুধু তাই নয়, শতাব্দির পর শতাব্দি পর্যন্ত অনেক নারীগণ হাদীসের প্রচার প্রসারে মূল্যবান ভূমিকা রেখে গেছেন । তারা  ছিলেন মুসলিম জাহানে ইলমে হাদীসের জগতে জ্যোতির্ময় উজ্জল জ্যোতিস্ক।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন-
১. আলীয়া বিনতে হাসসান।
২. আমেনা রমিলা।
৩. কারিমা বিনতে আহমাদ মারুজী।
৪. হামযাহ।
৫. আয়েশা বিনতে মুসলিম হাবরানী।
৬. ফখরুন্নিসা শাহিদা।
৭. উম্মুল খায়ের।
৮. বিবি সাফারী।
৯. ফাতেমা বিনতে ইব্রাহীম।
১০. বিবি সাতুল আহাল।
১১. জয়নাব বিনতে আব্দুর রহমান।
১২. বিবি মালেকা ।
১৩. খাদীজা বিনতে আহমাদ।

-তথ্যসূত্র: মেছালী খাওয়াতীন


এদের সবাই হাদীসের প্রচারে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ কারো থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না।
পরবর্তীতে দশম শতাব্দি থেকে দ্বীনী মাদারেস মারাক্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পৃথীবির আনাচে কানাচে বিভিন্ন জায়গায় হাদীসের দরস পৌঁছে যায়। এতে হাদীসের দরস গ্রহন ও হাদীসের প্রচার প্রসার নারীদের জন্য আরো সহজ হয়ে যায়।
পাক ভারতে হাদীসের দরস ১১ শতাব্দিতে এসে পৌঁছে। আর আমাদের বাংলাদেশে ১২ শতাব্দিতে এসে পৌঁছে।
এবং বাংলাদেশেও বিভিন্ন মাদারিসে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাগণও হাদীসের খেদমত করে যাচ্ছেন।
আর এভাবেই আবহমান কালের সেই ধারায় আজ পর্যন্ত ইলমে হাদীস এসে পৌঁছেছে। রাসূল (স)-কে না দেখা অন্তরের যাতনা রাসূলের বাণী শুনে শুনে কিছুটা লাঘব হয়েছে। শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় জানা ও সঠিক পন্থায় জীবনের সর্ব কাজ সম্পাদন সহজতর হয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url