কওমি মাদ্রাসার ইতিহাস।

সত্যের পথ দেখাতে, শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পৃথিবীতে আগমন করেছেন অনেক নবি-রাসুল। যারা পথহারা, বিভ্রান্ত মানব সমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। মূর্তিপূঁজা বাদ দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছেন। সমাজের পাপাচার, বিশৃঙ্খলার সমাধান দিয়েছেন। হৃদয়ের উত্তাপ আর চরিত্রের মাধূর্য দিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে গভীর বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন ভালবাসা মায়া মমতা দিয়ে। নবীগণের এই ধারাবাহিকতা শেষ হয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই হি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। তাঁর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষকে সত্যের পথ দেখানোর দায়িত্ব দেয়া হয় আলেমদের উপর। সাহাবাদের পর থেকে শুরু হয় আলেমদের পথ চলা। সমাজের কুসংস্কার দূর করে ইসলামের আলোকে তা গড়তে তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আসছেন।

দারুস সুফ্ফা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবার লক্ষ্য একটাই ছিল, কিভাবে সমাজে দ্বীনের আলো ছড়ানো যায়। প্রথম যামানায় এসব মাদরাসাগুলো ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কোন এলাকায় একজন বড় আলেম আছেন, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি মাদরাসা। এভাবেই মূলত বিশ্ববিখ্যাত মাদরাসাগুলো প্রতি ষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই মাদরাসাগুলো সরকারিভাবে পরিচালনা করা হয়। মুস লিম শাষিত দেশ গুলোতে শিক্ষা-দীক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই মাদরাসা। ইলমে ওহি সহ সব ধরণের শিক্ষা দেয়া হতো মাদরাসাতে। সরকারি সকল কাজ করতো মাদরাসার ছাত্ররা। তখন শিক্ষা বলতে মানুষ মাদরাসা শিক্ষাই বুঝতো।

বর্তমানে আমরা যে মাদরাসা দেখি তার সূচনা দারুস সুফফা থেকে হলেও এর প্রতিষ্ঠানিক সূচনা ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ইংরেজ শাসকদের অত্যাচারে, জুলু নির্যাতনের শিকার হয়ে কত আলেম শহিদ হয়েছেন তার সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। ১৮৫৭ স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হলে মুসলমানদের উপর নেমে আসে কঠিন নির্যাতন। হাজার হাজার গ্রাম উজার করে দেয় ইংরেজ হায়েনারা মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়। আলেমদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উঠে পরে লাগে। গ্রান্ডট্রাংক রোডের প্রতিটি গাছে আলেমদের লাশ ঝুলায়। সেই কঠিন পরিস্থিতে হযরত কাসেম নানুতবী (র.) প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। শুরু হয় দ্বীনি শিক্ষার এক নতুন ধারা। আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে লাখো মাদরাসা। ১৫০ বছর পূর্বে আকাবিরে দেওবন্দ যে সুদূর চিন্তা নিয়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। তার ফল আজো আমরা ভোগ করছি। এখনো আমাদের সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ আছে। মসজিদ গুলোতে দিন দিন মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে।


দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য:

দেওবন্দ মাদরাসার মূল লক্ষ্য ছিল দুটি। ১. ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন করতে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলা। ২. সমাজের কুসংস্কার দূর করে ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা প্রচার করতে এক দল যোগ্য আলেম গড়ে তোলা। তখনকার সময়ে আলেমগণ একই সাথে দুটি সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিলেন। বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা, মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর বাতিলের আগ্রাসনি থাবা। অন্যদিকে ইংরেজ শাসক গোষ্ঠির মুসলমাদের উপর অমানবিক নির্যাতন । একদিকে বিধর্মীয় সংস্কৃতির সয়লাভ অন্যদিকে আলেমদের বিলুপ্তি। ইসলামি চিন্তা-চেতনা পুনরায় বিকশিত করতে এবং বাতিলের মোকাবেলা জোড়দার করার লক্ষ্যেই দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠা । মূলত ১৮৫৭ সালে দিল্লীর মারকাযী মাদরাসার পতন হলে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পরে। সেই অভাব পূরণ করতে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ। হযরত কাসেম নানুতবী (রহ.) মাদরাসা পরিচালনার জন্য কিছু বুনিয়াদি নীতিমালা তৈরী করে দেন । যাকে উশুলে হাশতেগানা বলা হয় । তার মধ্যে আটটি নিয়ম ছিল। যা কওমি মাদরাসাগুলোর জন্য পালন করা আবশ্যক মনে করা হয় । আটটি নিয়ম হচ্ছে, ১. ব্যাপক ভাবে চাঁদা সংগ্রহ করা। ২. ছাত্রদের খানাপিনা অব্যাহত রাখা। ৩. শূরা গঠন করা । যারা মাদরাসার সার্বিক উন্নয়ের জন্য চেষ্টা করবেন ৪. খোদাভিরু ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। ৫. মাদরাসায় যে নেসাব নির্ধারণ করা হবে তা অবশ্যই শেষ করা। ৬. ধনীদের চেয়ে গরীবদের চাঁদা অধিক গুরুত্ব সহকারে নেয়া। ৭. সরকারি অনুদান বা সাহায্য পরিহার করা। ৮. মুখলিস ব্যক্তিদের থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা। এই আটটি নীতিমালার উপর দেওবন্দ ও ততকালীন মাদরাসা গুলো পরিচালিত হত।


দেওবন্দের চিন্তা-চেতনা:

দারুল উলুম দেওবন্দের মূল চিন্তা-চেতনা ছিল দ্বীন অর্জনের ক্ষেত্রে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব না করা এবং ধর্মের কোন শাখা প্রশাখা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা। এই দুটি গুণের কারণে দেওবন্দ আজ দ্বীনের সকল বিভাগে সুপ্রতিষ্ঠিত। দেওবন্দ তার এই দুই চেতনা নিয়ে ইলমে এহি ও উন্নত চরিত্র অর্জন করে ছিল। এ এজন্যই দেখা যায়, দারুল উলুম শুধু ইলম অর্জনকেই যতেষ্ঠ মনে করেনি। সাথে সাথে আত্মশুদ্ধির পথেও কঠোর অনুশীলন করেছে। দারুল উলুমের প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে একদিকে যেমন ছিল ইলমি যোগ্যতা অন্যদিকে ছিল আধ্যাতিক শক্তি। হযরত শাইখুল হিন্দ বলেন, তখনকার সময়ে দারুল উলুমকে দিনের বেলায় মনে হত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর রাতের বেলায় মনে হত খানকা।


নেসাবে তা'লিম:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মুসলমানগণ শুধু কুরআনের শিক্ষা গ্রহন করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর মুস লমানগণ কুরআনের সাথে হাদিসও পড়তে শুরু করে। এরপর যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার পরিবর্তন হতে থাকে। হিজরির চতুর্থ শতকে চিকিৎসা, গণিত, সৌরবিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি নেসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শাহ ওলীউলাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) তখনকার নেসাব পরিবর্তন করে নতুন সিলিবাস প্রণয়ন করেন ৷ দারুল উলুম প্রতিষ্ঠার সময় শাহ ওলীউলাহর সেই নেসাবকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।


আমাদের অবস্থান:

বর্তমানে কওমি মাদরাসা গুলোর অবস্থা হল, তারা না পারছে দেওবন্দের চেতনাকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে। না পারছে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন করতে। ছাত্ররা হীনমন্যতায় ভোগছে। উপরের জামাতে উঠলেই তারা চিন্তা করে, আমি এই ইলম দ্বারা কি করব। আমার জীবন পরিচালনার জন্য আমাকে আধুনিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সরকারি মাদরাসা থেকে পরীক্ষা দেয়ার প্রবণতা এখন অনেক বেশী। অনেক আলেম এখন চান কওমি মাদরাসায় আধুনিক শিক্ষার সিলেবাস চালু করতে। কেউ ভয় করেন বর্তমান যামানার যে অবস্থা, কওমি মাদরাসাগুলো যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেকের ধারণা ১৫০ বছর পূর্বের সেই নেসাব এখন আর চলবে না। আকাবিরে দেওবন্দ এখন থাকলে এই নেসাব পরিবর্তন করতেন। এমন হাজারো মতামত কওমি মাদরাসার মূল চিন্তা-চেতনাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা কি চাই আমারা নিজেরাও জানি না। যার কারণে আজ এর কোন সঠিক সমাধান হচ্ছে না। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ফকিহুল আসর মুফতি কামাল উদ্দিন আহমদ রাশেদী 'মাদারেস' গ্রন্থে এ বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন। এছাড়াও আরো বিজ্ঞা ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা আশা করব আমাদের শ্রদ্ধেয় ওলামায়ে কেরাম এসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করে আমাদের জন্য একটি উপযুক্ত ও উপকারী সিলেবাস প্রণয়ন করবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url