শিরকের পরিচয়, শিরকের শাস্তি, কয়েকটি শিরকী কাজ ও শিরক থেকে বাঁচার উপায়।


শিরকের বেড়াজালে মুসলিম উম্মাহ


قوله ذعالی : لو كان فيهما آلهة إلا الله لفسد ذا

অর্থাৎ যদি আসমান ও জমিনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ থাকতো, তাহলে উভয় জগত অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত।

-সূরা আম্বিয়া: ২


এ আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- মূল নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একজন হওয়া আবশ্যক যদি নেতৃত্বশীল ব্যক্তি দুই জন হয় তাহলে সমাজে অরাজকতা দেখা দেয় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তাই এটাকে নেতিবাচক বলা হয়েছে ।

তদুপরি মানুষ যদি আল্লাহ তায়ালার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে তবে তার অপরাধ যে কত তা সহজেই অনুমেয়।

তথাপি একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলমান জানা অথবা অজানা অবস্থায় আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সাথে শরীক সাব্যস্ত করে অপরাধের বেড়া-জালে পতিত হয়ে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের পথে যাচ্ছে । প্রতিকূলতার কালো ছায়ায় নিঃশেষ করেছে তাওহীদের প্রতি অকাট্য বিশ্বাস। কী এই জানা-অজানা শিরক? কী হবে এর থেকে পরিত্রাণের উপায়?


শিরকের পরিচয়

শিরক অর্থ অংশীদার করা বা সমকক্ষ নাব্যস্ত করা। কোরআনের ভাষায় শিরক হলো, কাউকে আল্লাহর সমতুল্য, সমকক্ষ বা তুলনীয় বলে মনে করা ।


এ ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামীনের বাণী

আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে সমকক্ষ সাব্যস্ত করোনা । বস্তুত: এসব তোমরা জান।

-সূরা বাকারা : আয়াত ২২


শিরকের প্রকারভেদঃ শিরক ২ প্রকার।

১. شرك جلی  ২. شرك خفى
১. شرك جلی বলা হয়, কোন বস্তু বা মানুষকে আল্লাহর সাথে শরিক করাকে ।
২. شرك خفى বলা হয়, রিয়া বা লোক দেখানোর জন্য যে ইবাদত করা হয় তাকে ।


শিরকের স্বরুপ

আল্লাহর কোন ক্ষমতায়, গুণে বা ইবাদতে অন্য কাউকে অংশীদার করাই শিরক। বিশ্ব সৃষ্টি, পরিচালনা, জীবনদান, মৃত্যুদান সকল ক্ষমতা আল্লাহর । অন্য কারও এরুপ কোন ক্ষমতা বা অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। অনুরুপভাবে আল্লাহর যে সমস্ত গুণাবলী তার জন্য নির্ধারিত তা অন্য কারও উপর প্রয়োগ করাও শিরক।
অনুরুপভাবে সেজদা করা, দোয়া, মানত, পশু জবাই, তাওয়াক্কুল, ভরসা, নির্ভরতা, আশা ইত্যাদি সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর । অন্য কারও জন্য এগুলো করার অর্থ হলো এগুলোতে তাকে আল্লাহর অংশীদার বানানো। এ সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন-
আর যেন সোজা দ্বীনের প্রতি মুখ করি সরল হয়ে এবং যেন মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত না হই।

-সূরা ইউনুস : আয়াত ১০৫


কুফরির অন্যতম প্রকার শিরক । সাধারণত যুগে যুগে কাফেরগণ আল্লাহর অস্তিত্ব, তার গুণাবলী, রুবুবিয়্যত অস্বীকার করে কুফরি করেনি বরং এগুলোতে তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করেই কুফরি করে।
ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মুশরিকগণ ফেরেশতা, বিভিন্ন নবী এবং সত্যিকার অলী বা কাল্পনিক অলীদের ভক্তির নামে ইবাদত করত। এদের ইবাদতের পিছনে এদের দুটি যুক্তি ছিল। প্রথমত: এরা আল্লাহর প্রিয়, কাজেই এদের ডাকলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় । দ্বিতীয়ত: এরা আল্লাহর কাছে শুপারিশ করে বিপদ কাটিয়ে দেন। এ ব্যাপারে আল্লাহর বাণী-
যারা আল্লাহর ব্যতীত অপরকে উপাস্য রুপে গ্রহন করে রেখেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের ইবাদত এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয় নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের মধ্যে তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা করে দেবেন।

-সূরা আয-যুমার : আয়াত ৩


এ সকল পথভ্রষ্ট মানুষদের মনগড়া মতের মূল বৈশিষ্ট ছিল দুইটি । প্রথমত, মুজিযা ও কারামতের বিষয় । নবীদের মুজিযা, অলীদের কারামত ও তাদের দোয়া কবুল হওয়ার বিষয়টি স্বীকৃত ও প্রশিদ্ধ। মুজিযা -কারামতকে নবী বা অলীদের ক্ষমতা বা অধিকার ভেবে তারা শিরক করে।
দ্বিতীয়ত: দোয়া, শাফায়াত ও দায়িত্বের বিষয়ে। নবী, ফেরেশতা ও অলীরা শাফায়াত করবেন বলে আসমানী কিতাব ও ধর্মগুলোতে বলা হয়েছে। দোয়া ও শাফায়াতকে তাদের ক্ষমতা ভেবে তারা শিরক করেছে। কোরআনে কারীমে বিভিন্ন ভাবে এ সকল ভ্রান্তি অপনোদন করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বার বার বলেছেন যে, মুজিযা, কারামত বা অলৌকিক কর্ম কোন নবী বা অলীর ক্ষমতা নয় । একান্তই আল্লাহর ক্ষমতা ও অধিকার । আল্লাহর ইচ্ছা এবং অনুমতিতেই নবীগণ মুজিযা দেখাতে পারেন। নিজস্ব ক্ষমতায় নয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
বলুন হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা স্বীয় ধর্মে অন্যায় বাড়াবাড়ি করোনা, যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।

-সূরা আল-মায়েদা : আয়াত ৭৭


কয়েকটি শিরকী কাজ :

১. আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে উপাস্য মনে করা।
২. গাইরুল্লাহকে সিজদা করা।
৩. গাইরুল্লাহর নামে কসম করা।
৪. আল্লাহ ব্যতীত কোন নবী, রাসূল অলীকে عالم الغيب মনে করা।
৫. পীর ফকির ইত্যাদির কাছে সন্তান চাওয়া।
৬. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মুক্তি দাতা মনে করা।
৭. গনকের কাছে ভবিষ্যৎ জানতে চাওয়া। ইত্যাদি।


শিরকের শাস্তি

আজ মুসলিম জাতি প্রবৃত্তির কুমন্ত্রণায় পড়ে শিরকে লিপ্ত হয়ে আছে । এর শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন। এ ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত এবং হাদীস রয়েছে। নিম্নে কিছু তুলে ধরা হলো
১. আল্লাহ তায়ালার বাণী
নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে তিনি তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্যসব গুনাহগারদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন। -সূরা নিসা: ১১৬
২. আল্লাহ তায়ালার বাণী
নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। -সূরা লুকমান : আয়াত ১৩
৩. আল্লাহ তায়ালার বাণী
নিশ্চয়, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। -সূরা আল-মায়েদা : আয়াত ৭২
৪. হযরত হাফসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি গনকের কাছে গিয়ে তাকে (এ ব্যাপারে সত্যবাদী জেনে) কোনো বিষয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করবে, তার চল্লিশ দিনের নামায কবুল হবে না। -মুসলিম শরীফ
৫. হযরত ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর কসম খেল সে নিশ্চিত শিরক করল।

-তিরমিযী, মেশকাত


শিরক থেকে পরিত্রাণের উপায়

শিরকের মত এই ভয়কর গুনাহে আজ হাবুডুবু খাচ্ছে আমাদের মুসলিম সমাজ। না! এভাবে আর চলতে দেয়া যাবে না এই মারাত্বক ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের মুসলিম সমাজকে। হ্যাঁ, এই ব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে এবং মুসলিম উম্মাহকে বাঁচাতে হলে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে—
*শিরক সম্পর্কে কোরআন ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা জেনে তদানুযায়ী ইসলামী জীবন গড়ে তোলা।
*ইতিপূর্বে দলীল ও প্রমানের মাধ্যমে যত প্রকার শিরক সাব্যস্ত হয়েছে, সে সকল প্রকার শিরকের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে অবগত করে সতর্ক করা।
*যারা প্রতিনিয়ত শিরক করেই যাচ্ছে, অথচ সে জানে না যে এটাই শিরক, তাদেরকে তাদের ভুলের কথা স্মরণ করিয়ে ভুলগুলো সুধরে দেওয়া।
আমাদেরকে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি ঈমান এনে তার ইবাদত করতে। সুতরাং আমাদের ঈমান হবে শিরকমুক্ত এবং ইবাদত হবে ইখলাস যুক্ত । অর্থাৎ শুধু আল্লাহর জন্য ইবাদত করতে হবে । সুতরাং আমাদের উচিত শিরকের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে শিরকী কার্যকলাপ থেকে নিজের ঈমান ও আমলকে হিফাজত করা ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url