সরল জীবন যাপনে হযরত আলী।


আশারাহ্ মুবাশশারাহ্


আড়ম্বরশূন্য জীবন যাপনে হযরত আলী

ইবনে আবি রাফে' বর্ণনা করেছেন, “কোন এক ঈদের দিনে আমি আলীর কাছে যাই। আমি সেখানে উপবিষ্ট থাকাকালীন তাঁর কাছে একটি সীলমোহর করা থলে আনা হয়। খলীফা শীলমোহর করা থলেটি খুলে কয়েকটি শুকনো রুটি বের করেন এবং পানিতে ভিজিয়ে সেগুলো নরম করে নেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ জাতীয় খাদ্য সীলমোহর করার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? কোন চোরও তো এগুলো চুরি করতে চাইবে না।

খলীফা মৃদু হেসে বললেন, আমি যত্নপূর্বক বন্ধ করে রাখি। কারণ আমার ছেলেমেয়েরা তৈল বা মাখনযুক্ত নরম রুটি মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করে। আমি জিজ্ঞাসা করি, আল্লাহ কি আপনার জন্যে ভালো খাবার হারাম করে দিয়েছেন।

খলীফা বললেন, না। সে খাদ্যই আমার জন্যে সঙ্গত যা খিলাফতের দরিদ্রতম ব্যক্তিও দিনে একবার খেতে পায়। জনগণের জীবযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব হলে অবশ্যই আমি খাবারের আমার মান উন্নত করব। আমি চাই তাদের মতই জীবন যাপন করতে, তাদের আনন্দে আনন্দিত হতে, তাদের দুঃখে দুঃখ ভোগ করতে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) বলেছেন, আমি এক ঈদের দিন খলীফা আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে নাশতা করতে আহ্বান করেন। আমি সম্মত হলাম। অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের খাদ্য আমাদের সামনে দেওয়া হল। আমি খলীফাকে বললাম, "আপনি একজন সম্পদশালী ব্যক্তি, খলীফা, রাষ্ট্রপ্রধান। আমি আশা করেছিলাম যে, আর কিছু না হোক অন্তত কিছু গোশত আমাদের সামনে দেওয়া হবে। কিন্তু সামনে কি দেখতে পাচ্ছি?” উত্তরে খলীফা বললেন, "আপনি সম্পদশালী রাজাদের কথা শুনছেন। তারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। আমাকে একজন দরিদ্র এবং সরল জীবন যাপনকারী প্রশাসক হতে দিন। আমি দীন শ্রমিকের জীবন যাপন করতে চাই।"

-কামাল উদ্দীন মুহামদ ইবনে তালহা মোতালিব-উস সউল


হযরত মোয়াইদা ইবনে গাফা বলেছেন, “একদিন আমি খলীফা আলীর সঙ্গে দারুল ইমারতে (গভর্নমেন্ট হাউজ) সাক্ষাৎ করতে যাই। তখন ছিল নাশতার সময়। আমি তাঁর সামনে কয়েকটি যবের রুটি এবং এক পেয়ালা দুধ দেখতে পাই । রুটিগুলো ছিল খুব মোটা এবং শক্ত। তাতে না ছিল তেল, না মাখন। অত শক্ত রুটি সহজে হাত দিয়ে ভাঙা কষ্টসাধ্য ছিল। আমি খলীফা আলী (রা)-এর ভৃত্য ফিজ্জা (রা)-কে বললাম, “ওহে ফিজ্জা! এই বৃদ্ধ মনিবটির প্রতি কি তোমাদের কোন দয়ামায়া নেই? তোমরা কি তাঁকে কিছু নরম রুটি দিতে পার না? সামান্য একটু তেল কিংবা মাখনও কি তোমাদের জোটে না?”

ফিজ্জা (রা) জবাব দিল, “নিজের প্রতি তাঁর নিজেরই যখন কোন দয়ামায়া নেই, তখন তাঁর প্রতি আমাদের দরদ থাকবে কেন ? তিনি কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর রুটির সঙ্গে যেন তেল বা মাখন মিশ্রিত না করা হয়। এমন কি আটা থেকে ভূষিও যেন পৃথক না করা হয়। আমি নিজেও তাঁর থেকে অনেক ভালো খাবার খেয়ে থাকি।"

একথা শুনে আমি তাকে বললাম, “হে আমীর নিজের প্রতি যুলুম করবেন না। আপনার বয়স, দায়িত্ব এবং কঠোর পরিশ্রমের কথা চিন্তা করুন। আর আপনার খাদ্য সম্বন্ধে একটু ভেবে দেখুন।”

খলীফা জবাব দিলেন, “ওহে মোয়াইদা! আল্লাহর রাসূল (স) কী খাবার খেতেন, সে সম্বন্ধে কি আপনার কোন ধারণা নেই? পর পর তিন দিন তিনি কখনও ভরাপেট আহার করেননি।”

-আহমদ বিন হাম্বল মসনদ।


হারুন ইবনে আনজা বর্ণনা করেছেন, "আমি পিতার সঙ্গে খেরোনক নামক স্থানে খলীফা আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তখন ছিল দারুণ শীতের সময়।

খলীফার পরিধানে ছিল অত্যন্ত পাতলা সূতিবস্ত্র তিনি শীতের হিমেল হাওয়ায় ঠক ঠক করে কাঁপছিলেন। আমার পিতা বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন, বায়তুল মালে আপনার এবং আপনার পরিবারের অধিকার তো আল্লাহ্ স্বীকার করেছেন। আপনি কেন সে অধিকারের সদ্ব্যবহার করছেন না?”

জবাবে খলীফা বললেন, “ওহে আনজা। আপনাদের বায়তুল মাল থেকে আমি কিছুই গ্রহণ করতে চাই না। এ পোশাকটিও আমি মদীনা থেকে এনেছি।

-ইবনে আহমদঃ আল মানাকির


কুফা নগরীর প্রসিদ্ধ জামা বিক্রেতা আবূ নুজিয়া বর্ণনা করেছেন যে, “একদিন হযরত আলী (রা) তাঁর দোকান থেকে দু'টি জামা খরিদ করেন। অপেক্ষাকৃত ভালো জামাটি তিনি কাম্বারকে প্রদান করেন এবং সস্তা দামের জামাটি নিজের জন্যে রাখেন।”

-আহমদ আল মানাকির


আমর ইবনে কায়েস খলীফা আলীকে (রা) তালি দেওয়া জামা পরার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে খলীফা বলেন, “হে অমর! এরূপ তালি দেওয়া পোশাক তোমার হৃদয়কে করবে কোমল এবং দূর করবে তোমার গর্ববোধ। আর এ পোশাকই তো এ দেশের দরিদ্র মুসলিমরা পরে থাকে।

-তাবারি : রিয়াজ-উন নাজারা; আলী আল মুসাকি : কানযুল উম্মাল


ইবনে নোয়াজা নামীয় জনৈক খারেজী কৃষ্ণা নগরীতে বাস করতেন। তিনি খলীফা আলী (রা)-এর তালি দেওয়া পোশাক পরার জন্যে বক্রোক্তি করে খলীফাকে উত্ত্যক্ত করতেন। একদিন তাঁর বিদ্রূপের প্রতিবাদে খলীফা তাঁকে বললেন, “যা খুশি বলার স্বাধীনতা অবশ্যই তোমার আছে। কিন্তু আমার পোশাকে আপত্তিকর তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? এর চেয়ে ভালো পোশাক তো এ দেশের সাধারণ মানুষ পরতে পায় না। তুমি তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবন-যাত্রার মানদণ্ডে কেন আমার বিচার করছ না ? আমি তাদের জীবন-যাত্রার মান যদি উন্নত করতে পারি, তখনই আমার জীবন-যাত্রার মান উন্নত করব। যে পর্যন্ত না তা সম্ভব হয়, আমি তাদেরই মত পোশাক পরব।”

-ইবনে আহমদ : আল মানাকিব

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url