মোহরের শরয়ী হুকুম, যৌতুকের উৎপত্তি ও যৌতুকের ক্ষতি।


নারী, এটি শব্দ, হাজার গুনের সমাহারে অপূর্ব এক সৃষ্টি! সহজাত হাজার মানবের গুণমুগ্ধতার কারণ এই নারী! নারী কোমলতার অনুপম সৃষ্টি! নারী তার কোমলতায় ও নম্রতায় মানবকে মুগ্ধ করে, সে তার রুপে, গুণে, সৌন্দর্যে ও মহিমায় সকল কিছুকে মহিমান্বিত করে,পূর্ণতা দান করে! নারীর এই নারীত্ব মানব হৃদয়ে তরঙ্গ সৃষ্টি করে, সমাজে বিপবী চেতনা ছড়ায়, নারী আত্না সামাজিক প্রানকে প্রানবন্ত করে তোলে, সর্বাঙ্গিন করে দেয় সার্বজনীন কল্যাণ।

এই নারী যখন কারো সঙ্গী হয়ে দাম্পত্য জীবন পাড়ি দেয়, তখন তার থেকে সুখ, শান্তি এবং প্রীতিময়তাই প্রত্যেক ব্যক্তির চির কাম্য । নারীর কিছু দায়িত্ব কর্তব্য ও বুদ্ধিমত্তা দাম্পত্য জীবনের স্বাচ্ছন্দের উৎস!

দাম্পত্য জীবনের এই বন্ধন সুখে দুঃখে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও অনুগ্রহের মাধ্যমে গড়ে উঠে । গড়ে উঠে এক জনের প্রতি অন্য জনের ত্যাগ তীতিক্ষার পরিনামে । আর এই জীবন তখন স্বার্থক ও সুখময় বন্ধনে রুপ নিবে, যখন একে অন্যের অধিকারগুলো নিষ্ঠার সাথে পূরণ করে, কর্তব্যের বিধিগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে, একে অপরকে সম্মান করে ও একে অপরের অধিকার বুঝে জীবন সাজাবে স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকের একে অন্যের প্রতি অধিকার আছে, যা প্রত্যেকের স্বকীয়তার পরিচায়ক।


প্রিয় পাঠক

সেই অধিকার সমূহ হতে একটি হচ্ছে মোহর যা স্ত্রীর অধিকার! যা তার বিবাহোত্তর বন্ধন এর ত্যাগ, নিজস্বতা বিসর্জন ও আত্নিক সমর্পনের জন্য সম্মাননা!

যা তার ভালোবাসা ও কর্তব্য পরায়নতার মর্যাদাময় উপহার, মোহরের স্বরুপ ঃ স্ত্রীকে মোহর প্রদান স্ত্রীর প্রতি তার স্বামীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, স্ত্রীর জন্যে তার সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তি, এবং তার অসহায়ত্বের গ্লানি দূরিভূত হওয়ার মাধ্যম!


মোহরের শরয়ী হুকুম

মোহর প্রদান করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পালনীয় বিধান যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ওয়াজিব বলা হয়।

যেমন আল্লাহ বলেন-


قد علمنا ما فرضنا عليهم.

অর্থ “আমি অবশ্যই অবগত আছি যা আমি স্বামীদের উপর ফরজ করে দিয়েছি ।”

-সূরা আহযাব : আয়াত ৫০


অপর স্থানে আল্লাহ বলেছেন-


و آتوا النساء صدقاتن نحلة.

অর্থ “অর্থাৎ নারীদেরকে সন্তুষ্টির সাথে মোহর প্রদান করো।”

-সূরা নিসা : আয়াত ৪


কিন্তু বর্তমান সমাজে এ বিষয়ে চরম অজ্ঞতা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়।

এমনও ব্যক্তি আছে যারা দ্বীনদার, তবে মোহরের বিষয়ে সচেতন নয় । এ ব্যাপারে উদাসীনতা এতো প্রকট যে, কিছু মানুষ নফল ইবাদত কে যতটা গুরুত্ব দেয়, মোহর কে ফরজ জানা সত্ত্বেও ততটা গুরুত্ব দেয়না । অথচ ফরজ হওয়ার সাথে সাথে এটি حق العباد যা আদায় করা ছাড়া দ্বীনদ্বারীর পূর্ণতা অসম্ভব!


মোহর প্রদানের বস্তু

আমাদের অধিক জনসাধারণ মনে করে যে, মোহর শুধু টাকার মাধ্যমেই দেয়া হয়, এটা ভ্রান্তি বৈকি! বরং মোহর বিনিময়যোগ্য যে কোন জিনিষের মাধ্যমে দেয়া যায়, তা যে কোন পক্রিয়ায়ই হোক না কেন! যেমন স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র ইত্যাদি।

তবে ধার্যকৃত পূর্ণ মোহর এক সাথে দেয়াকে শরিয়ত আবশ্যক করে দেয়নি । তবে একসাথে তা প্রদান করা উত্তম। বিয়ের পর পর মোহরের কিছু অংশ প্রদান করা আবশ্যক। বাকী অংশ স্বামী তার সামর্থ ও সুযোগ অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে আদায় করে দিবে।


মোহর নিয়ে অপব্যাখ্যা

অনেক মানুষ এ ধারনায় মত্ত থাকে যে মোহর নারীর মূল্য বা বিনিয়োগ । অথচ বিষয়টি এমন নয় । বরং মোহর এক সম্মানীনামা, যা প্রদানের কারণই হলো স্ত্রীকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করা, যথোপযুক্ত ভাবে তার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখা।

মোহর দেয়ার বিষয়টি নিছক কথার কথা বা এচ্ছিক হিসাবে মেনে নেয়ার কোন আচার পালন নয় । বরং এটি ফরজ ও গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী দায়িত্ব! যা পূর্ণভাবে বিবেচনার দাবী রাখে । এর যাবতীয় দিক শরয়ী ধারায় শরিয়ত অনুযায়ী নির্ধারিত। এ কারনেই মোহর প্রদানের মাধ্যমে নারীর এ অধিকার পরিশোধ করা প্রয়োজন।

একদিকে মোহর যেমন নারীর স্বাচ্ছন্দতার প্রতীক। অন্যদিকে নারীর সর্বাধিক বড় যন্ত্রনার ব্যাধি বলেও আরো একটি বিষয় আছে । উরফ যাকে যৌতুক বলে অভিহিত করে থাকে!

সময়টা যখন এমন চলছে যে, প্রতিটি মানুষ স্বীয় দাম্পত্য জীবনে সুখ ও শান্তিময় জীবনের জন্য উদগ্রীব, কারণ, শান্তিময় জীবনের অনুরণ মানুষের মানবিক জীবনের সার্বিক ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা মুছে দিতে পারে, পারে প্রভুর নিয়ন্ত্রনে নিয়ন্ত্রিত সুখের বন্ধনে জীবন সাজিয়ে দিতে।

যার শান্তিময়তা চির কল্যান, চির সফল ও চির অম্লান! ঠিক এই সময়টাতেই আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করে কিছু মানুষ দুনিয়ার মোহ ও সম্পদের লোভে সীমালঙ্ঘন করছে এবং নারীর জীবন ঠেলে দিচ্ছে চরম বিপর্যয়ে ও নৈরাশ্যের চারদেয়ালে।

যার প্রভাবে শতকরা ৯০ ভাগ বৈবাহিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত, বাতাসের সাথে ভেসে বেড়াচ্ছে অবলা নারীদের করুন সুরের আর্তনাদ ও তার প্রতিধ্বনি, বেজে যাচ্ছে হৃদয় কর্ণকুহুরে প্রীতিময়তা হারানোর আহাজারি, নির্যাতিতার আর্তচিৎকার । অনাকাঙ্খিত ভবিষ্যতের পথে আজ হাজারো নারী! এর কারন শুধুই যেন যৌতুক!

যে বা যারা এই অভিশপ্ত যৌতুকের কবলে পড়েছে তাদের জীবনেই নেমে এসেছে দুঃখ দুর্দশা কলহ, বিবাদ ও বিরহের কালো ছায়া!


কি এই যৌতুক?

যৌতুক শব্দের প্রতিশব্দ পণ, উভয়টির একই অর্থ । এ দুটি শব্দ সংস্কৃত থেকে এসেছে:

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: বিয়ের সময় কনের অভিভাবক এবং পরিবার মেয়ের ভবিষ্যত জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা ভেবে বর পক্ষের দাবীতে যে অর্থ, সম্পদ, অলংকার ও আসবাব পত্র প্রদান করে তাকেই আমাদের সমাজে যৌতুক বলে !


যৌতুকের উৎপত্তি

মূলত আমাদের মুসলিম সমাজে প্রচলিত এ প্রথাটি সংক্রামিত হয়েছে সহাবস্থানকারী হিন্দু ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে কন্যা সন্তান পিতা মাতার সম্পদের হিস্যা পায়না, তাই যা দেয়ার বিবাহের সময়ই দিয়ে দেয়া হয়। এ জন্যই অভিধানে Dowry বলতে হিন্দু কন্যার সহায়তা বুঝায়। আর Dowry শব্দের অর্থ যৌতুক!

কিন্তু! ইসলামী সমাজে কন্যা সন্তান পিতা, মাতা ও স্বামীর সম্পদের অংশ পায় । তাই ইসলামে কন্যা সন্তান কারো জন্য বোঝা নয় যে অন্যের ঘরনী হওয়ার জন্য তাকে ছোট হতে হবে।


যৌতুকের ক্ষতি

যৌতুক স্পষ্ট জুলুম ও সামাজিক অনাচার, ও নির্লজ্জ প্রথা, ক্রমে ক্রমে এ নির্লজ্জ প্রথা মুসলিম সমাজে বিস্তৃত হচ্ছে, মুসলমানরাও অর্থ লোভে এখন যৌতুক গ্রহন পূর্বক বিবাহ করছে।

বিবাহের মুল কেন্দ্রবিন্দু নারী, অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে যৌতুকই মুল আকর্ষনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

নববধু যত শালীন ও সুন্দরই হোকনা কেন উপটোকন বিহীন শ্বশুরালয়ে সে তিরষ্কারের পাত্রে পরিণত হয় । আর স্ত্রী কুশ্রী হলেও যৌতুকের কারনে সে হয়ে যায় সোনার হরিনী। একসময় পাড়া মহল্লার প্রতিবেশীরা নববধুকে স্বাগত জানাতে আসতো এখন তারা উপঢৌকন দেখতে আসে ইসলাম স্বামী কতৃক স্ত্রীকে মোহর প্রদান করা আবশ্যক করেছে অথচ স্বামী উল্টো স্ত্রী থেকে যৌতুক নিচ্ছে, ইসলাম এটা কস্মিনকালেও সমর্থন করেনা। কেননা এ ধরনের যৌতুক কখনো সন্তুষ্টচিত্তে দেয়া হয়না। বরং চাপে পড়ে, বাধ্যবাধকতায় দেয়া হয়! এটি ঘোর অন্যায়!


পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-

হে ইমানদারগণ, তোমরা পরস্পরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষন করোনা। -সূরা নিসা: আয়াত ২৯


এমনকি হাদীসে আছে-

কোন মুসলমানের মাল তার সন্তুষ্টি ব্যতীত নেয়া কারো জন্য হালাল নয়।” -মুসনাদে আহমাদ


বর্তমান সমাজে যৌতুক আদান প্রদানের পরিণাম এই দাড়িয়েছে যে, কন্যা সন্তান জন্ম নেয়াই একজন পিতার জন্যে চরম আত্ম গ্লানীর কারণ । অভিশপ্ত এই যৌতুক কত নিরাপরাধ মেয়েকে বেদনায় জর্জরিত করেছে, কত সুখ বিনষ্ট করেছে, কত মেয়েকে জীবিত থেকেও জীবনের সব দুঃখ সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে! তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই!


যৌতুক বনাম হাদিয়া

যদি কোন পিতা সম্পূর্ন স্বেচ্ছা প্রনোদিত হয়ে আপন মেয়ের ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা ভেবে তার কল্যাণার্থে কিছু প্রদান করে তবে তা জায়েয এবং সুন্নত । কেননা এ ক্ষেত্রে শরীয়ত প্রনেতা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর স্বীয় কন্যা ফাতেমাকে (রাঃ) দেয়া উপঢৌকনই এর জলন্ত ও সর্বোৎকৃষ্ট প্রমান।

তাছাড়া মূলত পিতা মাতার পক্ষ থেকে মূল্যবান উপহার হলো কন্যাকে শিষ্টাচার ও ধর্মীয় শিক্ষদান । আর স্ত্রীর সদ্ব্যবহার, ও আনুগত্যশীলতা, মাধূর্য, ও অল্পে তুষ্টি,নমনীয়তা ইত্যাদি গুণাবলীই স্বামীর জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।


যৌতুকের প্রতিকার

বর্তমান সমাজে যৌতুক প্রথা যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে যদি তা প্রতিরোধ না করা হয়, তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবন হয়ে উঠবে ভীষন ভয়াবহ ও দূর্বিসহ । তাই যৌতুক কেন্দ্রিক এ মন্দ বিষয়গুলো দূর করতে জনসাধারণের সোচ্চার হতে হবে । এ ধরনের মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে । শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এর বিরুদ্ধে ওয়াজ, নসিহত করতে হবে অথবা কলমের খোচায় লেখনী শক্তিতে তুলে ধরতে হবে এর সর্বনাশী ছোবল। এছাড়া সমাজের প্রচলিত কু-প্রথা ভ্রান্ত চিন্তা চেতনা দূরীকরনে সমাজের প্রতাপশালী, জ্ঞাণী-গুণীজন ও প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই! তাছাড়া বিত্ত্বশালী ব্যক্তিবর্গের মেয়েকে সম্পূর্ণ ঘর সাজিয়ে দেয়ার প্রথা বাতিল করতে হবে।

হয়তো আমাদের এই কিঞ্চিত প্রচেষ্টাই নারীকে যৌতুক বিহীন বৈবাহিক বন্ধনের প্রেমময় জীবনের রানী করে তুলবে। নারীকে দিবে সুখময় জীবন।

অবশ্য এ ব্যাপরে ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই । কারন ইসলামই অন্যায়, অবিচাররোধের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার । নারী অধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়নে সবচেয়ে সোচ্চার।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url