বিয়ের ইসলামী নীতি ও বিয়ের সুন্নত পদ্ধতী

বিয়ের সুন্নাত


বিশ্ব বিধাতা কর্তৃক মনোনীত ধর্ম ইসলাম। ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এতে কিছু মৌলিক নীতি রয়েছে। সেই ইসলামী মৌলিক নীতি বা শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলাম বৈরাগ্যবাদ ও একাকিত্বের জীবন পছন্দ করেনা। যেমন হাদীস শরীফে নবীজী এরশাদ করেন-


ان الله ابدلنا بالرهبانية الحنفية السمحة (البهقی)

অর্থ্যাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বৈরাগ্যবাদের বদলে সহজ সরল সঠিক ধর্ম দান করেছেন।


এছাড়াও বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ বুখারী ও মুসলিম শরীফের রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে।

নবীজী এরশাদ করেন-


يا معشر الشباب من استطاع منكم البائة فلهذزوج فانه اغ للبصر واحصن للفرج .

অর্থাৎ হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে, কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে অবনত রাখে, এবং লজ্জাস্থানকে (গুনাহ থেকে) হেফাযত করে।


শরীয়তে বিয়ের অবস্থান

নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন-


النكاح من سنذى- فمن رغب عن سنذى فليس مني

অর্থাৎ: বিয়ে করা হলো আমার সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং যে আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে আমার দলভুক্ত নয় ।


এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় বিয়ে সুন্নত। স্বাভাবিক অবস্থান বিয়ে করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আবার কখনো তা ফরজ, আবার কখনো ওয়াজিব হয়। এটা দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এর মাধ্যমে নিজের নফসকে ব্যভিচারে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। এবং এর দ্বারা বংশধারা জারি থাকে।

এছাড়া নবীজী এরশাদ করেছেন-

চারটি কাজ নবীদের সুন্নত । তার মধ্যে একটি হচ্ছে বিয়ে । বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে।

নবীজী আরো এরশাদ করেন-

বান্দা যখন বিয়ে করে তখন তার অর্ধ ঈমান পরিপূর্ণ হয় অতএব বাকী অর্ধেক ঈমানের ক্ষেত্রে সে যেন তাকওয়া অবলম্বন করে চলে।

-বায়হাকী

এ সমস্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বিয়ে মানুষের দুঃখ নিবারক,শান্তিদায়ক ও ধর্মের সহায়ক।

তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, বর্তমানে আমাদের সমাজে যে নিয়ম পদ্ধতীতে বিয়ের আয়োজন করা হয় তা সম্পূর্ন শরীয়ত বিরোধী ও সুন্নতের খেলাফ এবং বিধর্মীদের রীতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো,

বিনা পর্দায় প্রথম সাক্ষাত, গায়ে হলুদ, গেট ধরা, মেয়েরা বরের হাত ধোয়ানো, বিয়েতে বিপুল খরচ, অধিক মোহর নির্ধারণ ইত্যাদি

এগুলোর মধ্য হতে কয়েকটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিয়ে তুলে ধরা হলো

১. প্রথম সাক্ষাৎ:

ইসলামী শরীয়ত বেগানা (গায়রে মাহরাম) মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত করাকে হারাম করেছে। তবে বিশেষ কিছু স্থানে ইসলামী শরীয়ত মহিলাদেরকে দেখার অনুমতি দিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা।

যেমন নবীজী এরশাদ করেন-

যদি তোমাদের কেউ কোন নারীকে প্রস্তাব দেয় তাহলে শুধু বিবাহের উদ্দেশ্য তাকে দেখে নেয়াতে কোন অসুবিধা নেই, যদিও তার আগোচরে হয়।


এ ছাড়া আরো বিভিন্ন হাদীস দ্বারা পাত্রী দেখার বৈধতা সাব্যস্ত হয়।

তবে তাদেরকে দেখার একটি নির্দিষ্ট গন্ডি রয়েছে।


আর তা হলো চেহারা, উভয় হাতের তালু ও উভয় পায়ের পাতা। এছাড়া আর কোন অঙ্গ দেখতে পারবেনা । কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় যখন ছেলেরা মেয়ে দেখতে আসে তখন ছেলের সাথে তার বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু বান্ধবরা এসে থাকে । এটা সম্পূর্ণ অবৈধ । মেয়েকে শুধু ছেলেই দেখতে পারবে। তাও আবার নির্দিষ্ট কয়েকটি অঙ্গ । তবে যদি ছেলের পক্ষ থেকে কোন মহিলা দেখতে আসে তাহলে সে দেখতে পারবে।

২. ফোনালাপ ও দেখা সাক্ষাত:

একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে দেখার পর তাদের মাঝে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় তখন দেখা যায় তার একে অপরের সাথে ফোনে কথাবার্তা বা অন্য কোন ভাবে দেখা সাক্ষাত করে থাকে । অথচ বিয়ের আগে কথার্বাতা ও দেখা সাক্ষাত কোন ভাবেই জায়েয নেই।

৩. গায়ে হলুদ:

গায়ে হলুদ সাধারণত বিয়ের একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় । এটা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি, বিজাতীয় অনুকরণ ও অনৈসলামিক প্রথা। হলুদ বা কোন রং ব্যবহার করা পুরুষের জন্য সম্পূর্ন হারাম। মহিলাদের জন্য যদিও রং জায়েয, কিন্তু বর্তমানে যেরূপ বেপর্দা ও বেহায়াপনার সাথে গান বাজনা বাজিয়ে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হয় তা সম্পূর্ণ নিষেধ ও শরীয়ত পরিপন্থী।

৪. আরো কয়েকটি নিষিদ্ধ কর্মকান্ড:

বিয়ের দিন আমরা এমন কিছু কর্মকান্ড করে থাকি যা অবৈধ হওয়ার সাথে সাথে শালীন রুচিরও খেলাফ। যেমন-

১. যখন বর যাত্রী আসে তখন গেইটে ফিতা ধরা এবং বরের কাছে থেকে কিছু টাকা আদায় করা।

২. বরের যখন খানা খাওয়া শেষ হয় তখন যুবক-যুবতীরা মিলে বরের হাত ধোয়ানো।

৩. ছবি তোলা, ভিডিও করা, গান বাজানো ইত্যাদি।

এ সমস্ত কাজ সবই শরীয়ত বিরোধী কাজ। অথচ এখন এগুলোই হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক । এ সমস্ত আয়োজন ছাড়া যেন বিয়েই হয়না। অথচ এর থেকে বেঁচে থাকা একজন মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। এগুলো সব হলো বিধর্মীদের রীতি । অথচ আমরা তারই অনুসরন করি । অপরদিকে বিধর্মীরা আমাদের কতটুকু অনুসরণ করে । আমাদের উচিত বিয়ের সুন্নত পদ্ধতী জেনে সেই অনুযায়ী বিবাহ চুক্তি সম্পাদন করা । যাতে করে আমাদের বিয়ে বরকতময় হয়। আসুন আমরা বিয়ের সুন্নত তরীকা সম্পর্কে জানি।


বিয়ের সুন্নত পদ্ধতী

১. ইসলামী কানুন ঠিক রেখে প্রস্তাব দেয়া ও পাত্রী দেখা। অর্থাৎ শরীয়তে যতটুকু দেখার অনুমতি দিয়েছে ততটুকু দেখা এবং বেপর্দা ভাবে না দেখানো।

২. দ্বীনদারীর ভিত্তিতে পাত্র পাত্রীকে অগ্রাধীকার দেয়া। যেমন সহীহাইনে নবীজী থেকে বর্ণিত আছে-

চারটি বিষয় সামনে রেখে মহিলাদেরকে বিবাহ করা হয় । ১. মাল বা সম্পদ । ২. বংশ ৩. সৌন্দর্য ৪. দ্বীনদারী । সুতরাং তুমি দ্বীনের বিষয়টি প্রাধান্য দাও। অন্যথায় তোমার হাত ধূলায় ধুসরিত হোক।

-বোখারী ও মুসলিম

অপরদিকে তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে। নবীজী এরশাদ করেছেন-

যখন তোমাদের নিকট এমন কেউ প্রস্তাব দেয় যার দ্বীন ও চরিত্রকে তোমরা পছন্দ করো তাহলে তোমরা তার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তোমরা এরূপ না করো তাহলে জমিনের মধ্যে ফিতনা এবং মহা ফাসাদ সৃষ্টি হবে।

৩. মসজিদে বিবাহ সম্পাদন : মসজিদে দস্তরখানা বিছিয়ে খেজুর খুরমা ছিটিয়ে বিবাহ সম্পাদন করা সুন্নত। যেমন তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে, নবীজী এরশাদ করেন- তোমরা বিবাহকে প্রচার করো এবং মসজিদে বিবাহ সম্পাদন করো।

৪. শরীয়তসম্মত ভাবে মোহর নির্ধারনঃ দেনমোহর স্ত্রীর প্রাপ্য একটি অধিকার । যা দ্বারা নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আলাহ তায়ালা বলেন-

তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর প্রদান করো।

এখন প্রশ্ন হলো, কি পরিমানে মোহর নির্ধারণ করা হবে?

বর্তমানে আমাদের সমাজে দেখা যায় সাধ্যাতীত মোহর ধার্য করা হয়। আর তা হয় কেবল লৌকিকতা বশতঃ। এমন মোহর শুধু কাগজ কলমেই থাকে, তা আদায় করা হয়না। এরূপ মোহর ধার্য করা কখনোই উচিত নয় যা স্বামী আদায় করতে পারবেনা অথবা স্বামীকে স্ত্রীর নিকট মাফ চেয়ে উদ্ধার পেতে হবে। উত্তম হলো স্বামীর সাধ্যানুযায়ী মোহর নির্ধারণ করা। তবে মোহরে ফাতেমী নির্ধারণ করা বরকতময়। আর মোহরে ফাতেমী হলো ঐ মোহর যা নবীজীর প্রিয়তম কন্যা হযরত ফাতেমা (রা) এর বিয়েতে ধার্য করা হয়েছিলো। আর তার পরিমান হলো ৫০০ দেরহাম তথা ১৫৩০.৯ গ্রাম রূপা। যদি অধিক মোহর নির্ধারন করা কোন সম্মানের বস্তু হতো তাহলে আমাদের প্রেয়নবী (সা.) অবশ্যই তা করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।

যেমন, হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণিত- তোমরা নারীদের মোহর নির্ধারণে বাড়াবাড়ি করিওনা। কেননা অধিক মোহর নির্ধারন যদি দুনিয়ার সম্মানের বস্তু হতো অথবা আল্লাহর নিকট তাকওয়া হিসেবে পরিগণিত হতো তাহলে সে বিষয়ে মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের তুলনায় অধিক উপযুক্ত ও হকদার হতেন

-সুনানে ইবনে মাজাহ

এ সমস্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, বিয়েতে অধিক মোহর ধার্য করা যাবেনা । বরং সামর্থ্য অনুযায়ী মোহর ধার্য করবে।

৫. ওলীমা করা এবং স্বল্প খরচে ওলীমা করা: বৌভাত করা জায়েয আছে। বরং তা সুন্নত।

যেমন নবীজী এরশাদ করেছেন-

প্রথম দিনের খানা আবশ্যক। দ্বিতীয় দিনের খানা সুন্নত। আর তৃতীয় দিনের খানা লৌকিকতা।

নবী কারীম (সা.) ও ওলীমা করেছিলেন-

ওলীমা ঐ খানার নাম যা বিয়ের পর বরের বাড়িতে খাওয়ানো হয় । কিন্তু আমাদের সমাজ এর উল্টো। মেয়ের বাড়িতে শর্তারোপ যে খাবার খাওয়ানো হয় নিঃসন্দেহে তা সুন্নতের খেলাফ, গর্হিত কাজ। যা ইসলাম সমর্থন করেনা।

ওলীমা মানে বড় কোন ভোজসভা বা ভারি কোন খানা নয়। বর্তমানে ওলীমার নামে যে ব্যয়বহুল ও সাধ্যাতীত আয়োজন করা হয় তা শরীয়তের সুন্নত ওলীমার সাথে বিলকুল সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।

নবীজী এরশাদ করেন-


إن أعظم النكاح بركة ايسره مؤنة (رواه البيهقی)

অর্থাৎ ঐ বিবাহে অধিক বরকত যাতে খরচ কম।


তাছাড়া বর্তমানে গান-বাজনা বাজিয়ে, ভিডিও করে যে ওলীমা করা হয় তা শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ড। এটা বিবাহ বরকতশূন্য হয়ে আজীবন গজব হওয়ার কারণ। তাই উচিত ঘরোয়া পরিবেশে ওলীমা করা।

বাসর রাত্র

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, ইসলাম তার পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থায় এ রাত্র সম্পর্কেও দিক নির্দেশনা দিয়েছে। তা নিম্নরূপ:

*প্রথমে স্বামী নববধুর মাথায় হাত রেখে আল্লাহর নাম স্মরন করবে, এবং আল্লাহর নিকট নববধুর জন্য বরকতের দুয়া করবে।

* বর কনে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করবে।

* স্বামী নববধুর সাথে অত্যন্ত প্রীতিমধুর কথা বলবে ।

* কিছু হাদিয়া পেশ করবে। এতে পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হবে।  কমপক্ষে কিছু খাদ্যবস্তু হলেও পেশ করবে।


উপসংহার

ইসলাম ধর্ম আমাদের এত সুন্দর নিয়ম শৃঙ্খলা শিক্ষা দিয়েছে।  অথচ আমরা আজ তা ছেড়ে দিয়ে বিধর্মীদের অনুসরণ করছি। বিধর্মীরা কি আমাদের অনুসরণ করে? আমাদের উচিত নবীর তরীকা মেনে চলা । আল্লাহ ও তাঁর নবীর অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা। আসুন আমরা নবীর তরীকা অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অর্জন করি। আল্লাহ তায়ালা তাওফীক দান করুন। আমীন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url