সুন্নাত ও বিদআত, সুন্নাত কাকে বলে ও বিদআত কাকে বলে
মুহাম্মদে আরাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পূর্ণ জীবনের সাধনায় উম্মতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা রেখে গেছেন, তাতে কোন প্রকার পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের অবকাশ নেই। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যে পথ ও আদর্শ মানবমন্ডলীর জন্য রেখে গেছেন তাই হচ্ছে সুন্নত এবং এর বিপরীত যা কিছু রয়েছে তা হচ্ছে বিদআত।
সুন্নত তো ইসলামের এমন এক অনুসৃত নিয়মনীতি, যার অনুসরণ করা সকল অবস্থাতেই অপরিহার্য। সুন্নত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় । কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে মানুষ সুন্নতকে বর্জন করে বিদআ'তকে আঁকড়ে ধরেছে। যেমন তাওহীদকে বর্জন করে শিরক এর পথ গ্রহন করেছে।
আমরা ইবাদত করি একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ব্যতীত আর কারো ইবাদত করা যাবেনা। তেমনি অনুসরণীয় ব্যক্তি মাত্র একজন। তিনি হলেন, রাসূলে কারীম (সা.)। যেমন আল্লাহকে এক বলে স্বীকার করে একমাত্র তারই এবাদত করি, তেমনি অনুসরণের ক্ষেত্রে একমাত্র বিশ্বনবীকেই অনুসরণ করতে হবে । তাঁর সুন্নাহ বিরোধী কোন আমল যদি আমরা করি তাহলে সেটাই হবে বিদআ'ত।
নবীজীর পবিত্র জীবন চরিত্রের এমন অনেক দিক রয়েছে, যার প্রতি অনিচ্ছায়ও আমাদের নজর
যায় না । অথচ আমরা প্রতিনিয়তই সে সকল বিষয়ের সম্মুখীন হচ্ছি। তাঁর পবিত্র জীবন চরিত্র নিয়ে কুরআনে কারীমের সর্বাধিক সুষ্পষ্ট আয়াত
لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة.
“নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে রাসূলাল্লাহ এর পবিত্র জীবনীতে ।"
-সূরা আহযাব : আয়াত ২১
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমুদয় নেককাজ একজায়গায় জমা করে দিয়েছেন । তার চাবি হল ইত্তেবায়ে সুন্নত বা সুন্নতে রাসূলের অনুসরণ ।
রাসূলে আরাবী এরশাদ করেন-
من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله
এ হাদীসে সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি রাসূলের অবাধ্যতা করবে, রাসূলের সুন্নতের বিরোধী কাজ করবে, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে আল্লাহর অবাধ্যতা করল, সে নিঃসন্দেহে জাহান্নামে যাবে ।
উপমহাদেশে ইসলামের আলো বিকশিত হওয়ার পূর্বে পৌত্তলিক ধর্ম ও রীতিনীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এ দেশের লোকজন ধর্মীয়ভাবে মুর্তিপূজা, কবর পূজা, মানুষকে সিজদা করা, মুর্তি ও কবরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি শিরকী কাজে লিপ্ত ছিল । কালক্রমে মুসলিম মনীষীগণ তাওহীদের দাওয়াত পেশ করলে তারা ইসলাম গ্রহণ করে । কিন্তু ইসলামের পাশাপাশি ইলমে নববীর ব্যাপক সম্প্রসারণ না থাকায় লোকজন সহজেই নানা প্রকার বিদআত ও রুসুম রেওয়াজের শিকারে পরিণত হয় । এমনকি যেসব মনীষী দেশবাসীকে শিরকের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে হিদায়াতের আলোকিত পথ দেখিয়েছিলেন তাদের ইন্তেকালের পর তাদেরই কবরকে কেন্দ্র করে লোকজন পুনরায় শিরকে লিপ্ত হয়। আর সমাজে নেমে আসে শিরক-বিদআতের ভয়াবহ সয়লাব। সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে রাজ-দরবার পর্যন্ত এ বিদআতের বহু প্রথা প্রচলন সম্প্রসারিত হয়।
মুসলিম সমাজে বিদআত অত্যন্ত পবিত্রতার ছদ্মাবরণে এবং অতিশয় সঙ্গোপনে অনুপ্রবেশ করে থাকে। তারপর কায়েমী স্বার্থবাদী মহল দুনিয়াদার পীর ফকির ও ভন্ডদের তত্ত্বাবধানে তা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।
কুরআন-হাদীসে বিদআতের নিন্দা
কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন-
ولا ذكونوا من المشركين . من الذين فرقوا دينهم وكانوا شيعا شكل حزب بمالديهم فرحون
হাদীসে বিদআতের খারাপ দিক এবং তা হতে বেঁচে থাকার অসংখ্য বর্ণনা উল্লেখ রয়েছে।
রাসূলে আরাবী (সা.) বলেন-
من احدث في أمرنا ما ليس منه فهو رد .
অপর এক হাদীসে এসেছে:
নবী করীম (সা.) খুৎবার মাঝে বলেছেন- হামদ ও সালাতের পর, জেনে রাখ, সর্বোত্তম বাণী হল আল্লাহর কিতাব, কুরআন। সর্বোত্তম জীবন-বিধান হল মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন-বিধান । প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী । আর প্রত্যেক গোমরাহীই জাহান্নামে যাবে।
নবী করীম (সা.) আরো বলেছেন-
যে ব্যক্তি লোকদেরকে হেদায়াতের পথে আহ্বান করবে, তাকে সকল অনুসারীদের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে। অথচ তাদের থেকে সামান্যতমও সওয়াব কমানো হবেনা।
আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর দিকে মানুষদেরকে ডাকবে, তাকে সকল অনুসারীদের গোনাহ পরিমাণ গোনাহ দেয়া হবে। অথচ তার অনুসারীদের থেকে সামান্যতম কমানো হবেনা।
কাজেই বিদআতের নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবনকারীদের এবং তার দিকে আহবানকারীদের সামান্যতম চিন্তা করা দরকার যে, তাদের ডাকে যারা সাড়া দিচ্ছে তারাই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ নয়। বরং সকল পথভ্রষ্ট লোকদের সমপরিমাণ গুনাহও তার আমলনামায় লেখা হচ্ছে।
এখন লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কে সুন্নী আর কে বিদআতী? কারণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কিছু কিছু লোক রয়েছে যারা বিদআতী কর্মকান্ডে সদা-সর্বদা লিপ্ত থেকে জীবনের প্রতিটি দিককে সুন্নতের উল্টো দিকে চালাচ্ছে, তারপরও নিজেকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত তথা সুন্নী বলে দাবী করছে। দেখা যাচ্ছে সারাদিন মদ, জুয়া, নাচ, গান, সিনেমা বিভিন্ন শরীয়ত বিরোধী কাজে নিজেকে লিপ্ত রাখছে । আর মুখে সুন্নী বলে দাবী করছে।
আর যারা তাদের বেদআতকে সমর্থন করেনা বরং দৃঢ়ভাবে নবীজীর রেখে যাওয়া সুন্নত মোতাবেক নিজেকে চালাচ্ছে, জীবনের প্রতিটি স্তরে নবীজীর সুন্নত বাস্তবায়নে সর্বদা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে, তাদেরকেই তারা রাসুলের শত্রু, ওহাবী ইত্যাদি বলে গালমন্দ করছে।
কাজেই বাস্তবিকভাবে কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে কে সুন্নী আর কে বিদআতী তা স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক।
সুন্নী তথা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লামা ইবনুল (রা) বলেন- সন্দেহহীন ভাবে বলা যায় যে, হযরত নবী করীম (সা.) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামে আদর্শের অনুসারীরাই হচ্ছে সুন্নী । কারণ তারাই প্রকৃতপক্ষে নবীজীর সুন্নতের আদর্শকে অনুসরণ করছে।
রাসূলে আরাবী (সা.) স্বয়ং সুন্নীর পরিচয় দিতে গিয়ে দীর্ঘ এক হাদীসের শেষাংশে বলেছেন-
ما انا عليه واصحابي .
“সুন্নী লোক তো হচ্ছে তারা, যারা আমার ও আমার সাহাবাদের আদর্শের অনুসরণ করবে।”
-তিরমিযী