ইসলামে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও অধিকার হরণের ভয়াবহতা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার নাম। ইনসাফ ও ন্যায়-নিষ্ঠার ধর্ম। একমাত্র ইসলামই দিয়েছে সকল মানুষকে তার যথাযথ পাওনা ও অধিকার। মানুষকে তার স্বীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করাকেও ইসলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলাম পূর্ব জাহিলিয়াতের যুগে নারী ছিল লাঞ্ছনার প্রতীক। জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। ছিল না সম্পত্তিতে নারীর কোন অধিকার। ইসলাম কন্যা সন্তানকে অভিহিত করেছে সৌভাগ্যের প্রতীক। প্রতিষ্ঠিত করেছে সর্বপ্রথম নারীর সম্মান-মর্যাদা ও অধিকার। পুরুষের ন্যায় নারীকেও দিয়েছে সম্পত্তিতে অংশ বরং কখনো নারীকে পুরুষের তুলনায় বেশিও দিয়েছে। কিন্তু একজন নারী সন্তান হিসেবে পিতা-মাতা থেকে, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী হিসেবে স্বামী থেকে এবং মা হিসেবে সন্তানদের থেকে অংশ পায়। এসব অংশ এবং স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত মোহরানা যথাযথভাবে তাকে দেওয়া হলে নারীর সম্পত্তি পুরুষের অংশের চেয়ে কোন অংশেই কম হয় না। অপরদিকে একজন নারীর জীবনে আর্থিক কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বরং জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নারীর যাবতীয় ব্যয়ভার পুরুষের কাধেই তুলে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের আর্থিক খরচাদী জন্ম থেকে বিয়ে পর্যন্ত বাবার, বিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত স্বামীর দায়িত্বে তুলে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু একজন পুরুষ তার ব্যক্তিগত আয় ও সম্পদ থেকে তার পরিবার, স্ত্রী ও সন্তানদের জন্যও খরচ করতে বাধ্য আর একটি সর্বস্বীকৃত নীতি হল- الغر بالغنم “দায় অনুযায়ী প্রাপ্তি” অর্থাৎ যার দায় বেশি তার প্রাপ্তি বেশি। যার দায় কম তার প্রাপ্তি কম। তাই আল্লাহ তায়ালা নারীকে বাবার সম্পত্তিতে ভাইয়ের তুলানায় অর্ধেক অংশের মালিক বানিয়েছেন। পিতার সম্পত্তিতে নারীর এই নির্দিষ্ট অংশ ইসলাম ও আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে স্বীকৃত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের বিষয়ে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে এক ছেলের অংশ দুই মেয়ের অংশের সমান। আর যদি সন্তান শুধুই মেয়ে হয় তাহলে তারা একাধিক হলে পুরো সম্পদের দুই-তৃতিয়াংশ পারে। যদি এক মেয়ে থাকে তাহলে সে পূর্ণ সম্পত্তির অর্ধেক পাবে"
-সূরা নিসা-১১
অন্য আয়াতে আছে- "পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে, অল্প হোক কিংবা বেশি হোক। এ অংশ নির্ধারিত”।
-সূরা নিসা-৭
ইসলাম নারীদেরকে যথাযথ অধিকার দিলেও কিন্তু আমাদের সমাজের বাস্তবতা হচ্ছে যে, নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বীয় অধিকার থেকে বঞ্চনার শিকার। স্বামীগণ মোহরানা ঠিকমত আদায় করে না। পৈতৃক সম্পত্তির অংশ তাদেরকে ঠিকমত বুঝিয়ে দেওয়া হয়না। দিলেও কম দেওয়া হয় কিংবা বোনেরা ভাইদের অসন্তুষ্টির ভয়ে বা চাপের শিকার হয়ে তাদের অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কারণ যদি তাদের অংশ নিতে ভাইদেরকে চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে অনেক সময় ভাইয়েরা তাদের অংশ দিয়ে দিলেও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে বোনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। আবার অনেক জাগায় তাদেরকে | সম্পত্তি তাদের কাছে হস্তান্তর না করে নামেমাত্র মূল্য দিয়ে বিদায় করে দেওয়ার প্রচলন। রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়বহ যে, ভাইয়ের কাছ থেকে প্রাপ্য অধিকার নেওয়াকে সমাজের চোখেও অপরাধের মত দেখা হয়। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এ ভাইয়েরাই তাদের শশুর বাড়ী থেকে স্ত্রী কর্তৃক তাদের পিতা থেকে প্রাপ্য অংশের সামান্য পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি হয় না।
কখনো কখনো পিতা তার জীবদ্দশায় সন্তানদের মাঝে সম্পত্তি বন্টন করে দিয়ে যান। তখনও অনেক সময় পিতাগণ তাদের কন্যাদের উপর এরূপ অবিচার করে থাকেন। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে পিতা তার কন্যাকে বা ভাই তার বোনকে এমনিভাবে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে তার প্রাপ্য হক্ব থেকে একিইবারে বঞ্চিত করা বা কম দেওয়া কিংবা কৌশলে হক্ব ছিনিয়ে নেওয়া সম্পূর্ণরূপে তার উপর জুলুম যা নাজায়েয ও হারাম।
জালেমদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “জুলুমবাজরা তাদের জুলুমের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে”।
-সুরা আশ শুআরা: ২২৭
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করো না।
-বাকারা-১৮৮
নারী-পুরুষের অংশ সমূহ বর্ণনা করার পর আল্লাহ তায়ালা বলেন-
এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নদী প্রাহিত এবং সে সেখানে স্থায়ী হবে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমাকে লঙ্ঘন করবে তিনি তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।
-সূরা নিসা-১৩-১৪
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- “আত্মীয়-স্বজনকে তার অধিকার দিয়ে দাও”
-সূরা বনি ইসরাঈল-২৬
এভাবে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারীমের একাধিক স্থানে বান্দার হক্ব ও অধিকার নিজ নিজ প্রাপককে দিয়ে দেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং যারা অপরের অধিকার হরণ করবে তাদের শাস্তির কথা বলেছেন।
এ ধরণের অবিচার ও বৈষম্য মূলক আচরণের ভয়াবহতার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ওয়ারিসকে তার মিরাস থেকে বঞ্চিত করবে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের মিরাস থেকে তাকে বঞ্চিত করবেন।
-মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ ১৬/২১৫
এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- একদা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পাশে উপবিষ্ট সাহাবিদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কি জানো, প্রকৃত গরীব কে? সাহাবিরা বললেন, আমাদের মধ্যে গরীব তাদেরকে বলা হয় যাদের কাছে ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা থাকে না। তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রকৃতপক্ষে আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে গরীব সে, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোযা, যাকাত সব কিছু নিয়ে উঠবে, কিন্তু সে দুনিয়ায় কারো সাথে মন্দ আচরণ করেছে, কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কাউকে খুন করেছে ইত্যাদি। যার কারণে সেদিন তার নেকিগুলো দিয়েই হক্বদারের হক্ব পরিশোধ করা হবে। যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায় তাহলে এই হক্বদারের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
যে ভাই-বোনকে তার অংশ দিয়ে দেওয়ার পর তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার ব্যাপারেও কুরআন-হাদীসে বিভিন্ন ধরণের শান্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। এটিও একটি মারাত্মক অপরাধ। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদেরকে লা'নত ও অভিসম্পাত করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ তায়ালা এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির, দৃষ্টিহীন”।
-সূরা মুহাম্মদ-২২
হাদীসে আছে- “তিন ধরণের ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও যাদুতে বিশ্বাসী”।
-মুসনাদে আহমদ-১৯৫৮৭