কুতুবে আলম হযরত ক্বারী ইব্রাহীম (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানাধীন উজানী জামেয়া ইসলামিয়া ইব্রাহীমিয়ার (মাদরাসা) প্রতিষ্ঠাতা কুতুবে আলম হযরত ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব (র) নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ থানার অন্তর্গত দৌলতপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতার নাম পানামিয়া ভূঁইয়া (জমিদার)। হযরত ক্বারী সাহেব (রহ.) প্রথমে তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি শৈশবকাল থেকেই আরাম-আয়েশ এড়িয়ে একবারে সাদা-সিধে চাল-চলনে অভ্যস্ত ছিলেন।

হযরতের আম্মাজান খুবই আবেদা সালেহা ইবাদতগুজার ছিলেন। তিনি মাকে খুবই মহব্বত করতেন। তিনি সন্তানের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য সব সময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন । হযরত কারী সাহেব (রহ.) খুবই শান্ত-শিষ্ট প্রকৃতির ছিলেন।

অল্প বয়সেই তিনি ইলমে নববী অর্জন করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন।

কিন্তু এই আবেগ কার নিকট প্রকাশ করবেন। শেষ পর্যন্ত প্রাণপ্রিয় মায়ের নিকটই তাঁর এই সুপ্ত আবেগ প্রকাশ করে ফেললেন।

মায়ের অনুমতি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন।

সেখানে তিনি বেশ কয়েক বছর লেখাপড়া করেন। তারপর মক্কা শরীফে গিয়ে মক্কার প্রসিদ্ধ সাওলতিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ইলমে ক্বিরাত শিক্ষা করতে থাকেন। তাঁর চেষ্টা, মেহনত, আদব আখলাক ও লেখাপড়ার আগ্রহের কারণে কিছুদিনের মধ্যে তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় উস্তাদসহ সকলের প্রিয় ভাজন হয়ে উঠেন।

সেই মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায়ই তখনকার বাদশাহ সাইয়্যেদ শরীফ হোসাইন (রহ.) আরবের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের প্রসিদ্ধ ক্বারীদের এক মহা ক্বেরাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

সে অনুষ্ঠানে দাওয়াতী মেহমান ছাড়া অন্য কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। যেহেতু হযরত ক্বারী সাহেব (রহ.) দাওয়াতী মেহমান ছিলেন না, তাই তিনি ফটকের সামনে বসে প্রসিদ্ধ ক্বারীদের তেলাওয়াত খুব মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকেন।

ঘটনাক্রমে বাদশাহর কাছে হযরত ক্বারী ইবরাহীম (রহ.) এর সংবাদ পৌঁছে যায়। তাই বাদশাহ হযরত ক্বারী সাহেব (রহ.) কে ভিতরে নিয়ে তাঁর তেলাওয়াত শুনেন। তাঁর তেলাওয়াত শুনে সকলে অবাক হয়ে যায়। লোকেরা বলতে লাগলো- এতো সেই মিশরের অন্ধ মেয়ের মতো সুর, যে মেয়েটি মক্কা শরীফের বাবে ইবরাহীমে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতো। কিন্তু তার সুর কেউ অনুকরণ করতে পারতো না।

বাদশাহ শরীফ হোসাইন (রহ.) হযরত ক্বারী ইবরাহীম (রহ.) এর এই অপূর্ব সু শুনে তাকে সাওলতিয়া মাদ্‌রাসায় ইলমে ক্বিরাতের শিক্ষক পদে নিযুক্ত করেন। মক্কাতেই তিনি বিবাহ করেন দশ বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে ক্বোরআন শিক্ষা দেয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি এক এক স্থানে ১৫ দিনে ১ খতম কোরআন শরীফ পড়ে লোকদেরকে শিক্ষা দিতেন।

তাঁর সুমধুর স্বর, হৃদয়গ্রাহী সুরে মানুষ পতঙ্গের ন্যায় তাঁর কাছে ছুটে আসতে লাগলো।

এক সময় তিনি তাঁর বাড়ির সামনে ইলমে ক্বিরাতের মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসা স্থাপন করেন বটে কিন্তু যাতায়াতে ছিল খুবই অসুবিধা। জায়গা ছিল অল্প। তাই তিনি বর্তমান চাদপুর জেলার উজানী গ্রামে একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেন। গ্রামের লোকদের সহযোগিতায় ও আল্লাহ তায়ালার ফজল ও করমে মাদ্‌রাসাটি ক্রমে উন্নতি লাভ করতে থাকে ।

হযরত ক্বারী ইবরাহীম সাহেব (রহ.) ও স্থায়ীভাবে সেই উজানী গ্রামে বসবাস শুরু করেন।


খেলাফত লাভ :

হযরত ক্বারী ইবরাহীম সাহেব (রহ.) ফকীহুল মিল্লাত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী (রহ.) এর কাছে বায়াত হন। মাত্র সতের দিনের অক্লান্ত সাধনায় তিনি খেলাফত লাভ করেন।
হযরত ক্বারী ইবরাহীম (রহ.) একটি মূহূর্তও আল্লাহর যিকির ছাড়া থাকতেন না, তাঁর মধ্যে আল্লাহর প্রেম এতো গভীর ছিল যে, মাঝে মাঝে তিনি চিৎকার করে উঠতেন। আর অধিকাংশ সময় মাজযুব অবস্থায় থাকতেন। তার যিকিরের খুব তাসীর হতো। অনেক মুরীদ তাঁর এই যিকিরের ভাসীর সহ্য করতে না পেরে পাগলের মতো হয়ে যেতো।
এই মহান ব্যক্তিত্ব, আল্লাহ প্রেমিক, তাজুল আউলিয়া হযরত ক্বারী ইবরাহীম (রহ) ১৩৪৯ বাংলা ২২ই ফাল্গুন এই দুনিয়া ত্যাগ করে মাওলার দরবারে চলে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁকে উজানীর নিজ পারিবারিক কবরস্থানেই সমাহিত করা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url