হযরত আদম (আ.) জান্নাতে কতদিন ছিলেন ?

 


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, ইবলিসকে জান্নাত থেকে বহিস্কার করার পর হযরত আদম (আ.) কে জান্নাতে স্থান প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন একা তাই তাঁর ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয় হযরত হাওয়া (আ.) কে, আদম (আ.) জাগ্রত হয়ে যখন তাঁকে দেখলেন তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কে ? আর কেন তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? উত্তরে হাওয়া (আ.) বললেন, আমাকে আপনার জীবন সঙ্গিনী হওয়ার জন্যে এবং আপনার শান্তি ও শান্তনার উপকরণ স্বরূপ সৃষ্টি করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ পাক হযরত আদম (আ.) কে সম্বোধন করে বললেন :
یادم اسكن انت وزوجك الجنة وكلا منها رغدا حيث شئتما. ولاتقربا هذه الظلمين. الشجرة فتكونا من

“হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী বেহেস্তে বসবাস কর, এবং তোমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পানাহার কর। তবে তোমরা ঐ গাছটির নিকটবর্তী ও হয়োনা। অন্যথায় তোমরা অত্যাচারীদের মধ্যে পরিগনিত হবে।” (সূরা বাকারা-৩৫)

এখন জানার বিষয় হলো, ঐ গাছটি কি গাছ ছিল? যে গাছ থেকে উভয়কে নিষেধ করা হলো।

গাছটি কি গাছ ছিল এ নিয়ে তফসীর বিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, গাছটি ছিল গম গাছ,কেউ বলেছেন আংগুর গাছ, আবার কেউ কেউ বলেছেন, গাছটি ছিল খেজুর গাছ; তবে সমস্ত তফসীর বিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে, প্রকৃত পক্ষে গাছটি কি গাছ ছিল তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন, কোরআন ও হাদীসের কোথাও এর নির্দিষ্ট কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।

এখন কারো প্রশ্ন হতে পারে যে, আল্লাহ পাক সমস্ত কিছুর অনুমতি দেয়ার পর এই একটি গাছের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন কেন?

আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) বলেছেন: এই গাছকে নিষিদ্ধ করা ছিল হযরত আদম (আ.) এর জন্যে পরীক্ষা স্বরূপ।

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানী থানভী (রহ.) বলেছেনঃ প্রত্যেক বাড়ির মালিক ইচ্ছা করলে তার ভৃত্যকে বাড়ির কিছু জিনিস যথা ইচ্ছা ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন এবং কোন জিনিস ব্যবহার করতে নিষেধও করতে পারেন। হযরত আদম (আ.) এর সম্পর্কেও আল্লাহ পাক ঠিক এমন ব্যবস্থাই করেছিলেন, যে যেখানে ইচ্ছা যেতে পার, যা ইচ্ছা খেতে পার, কিন্তু এই গাছটি তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ, এই গাছটির কাছেও যেয়ো না। “গাছটির কাছেও যেয়ো না” প্রকৃত পক্ষে এর দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল সে গাছের ফল না খাওয়া। কিন্তু তাকীদের জন্য বলা হয়েছে কাছেও যেয়ো না।

এখন এখানে একটি বড় ধরনের প্রশ্ন হয়, আর তাহল আল্লাহ তায়ালা ঐ গাছটিকে নিষিদ্ধ করলেন, অথচ হযরত আদম (আ.) এবং হযরত হাওয়া (আ.) ঐ গাছের ফল খেলেন, তবে কি তাঁরা অবাধ্য এবং পাপী? এদিকে এটাও সর্ব সম্মত মত যে, নবীগন সমস্ত পাপ থেকে পবিত্র। তাহলে এর উত্তর কি?


উত্তরঃ কোরআন পাকের বিভিন্ন স্থানে কোন কোন নবী (আ.) সম্পর্কে এমন কিছু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যা থেকে বাহ্যিক ভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁদের দারাও পাপ সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু এ ধরণের ঘটনাবলী সম্পর্কে উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, কোন ভূল বুঝাবুঝি কিংবা অনিচ্ছাকৃত কারনে নবীদের দ্বারা এ ধরনের কাজ সংঘটিত হয়েছে, কোন নবী (আ.) জেনে শুনে কিংবা ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ পাকের হুকুমের পরিপন্থী কোন কাজ করেন নি। তাঁদের থেকে ঘটমান ত্রুটি গুলো ইজতেহাদগত ও অনিচ্ছাকৃত এবং তা ক্ষমার যোগ্য। শরীয়তের পরিভাষায় একে পাপ বলা চলে না।

কিন্তু যেহেতু আল্লাহ পাকের দরবারে নবীগণের স্থান ও মর্যাদা অত্যন্ত উঁচু স্তরে, এবং যেহেতু মহান ব্যক্তি বর্গের দ্বারা ক্ষুদ্র ত্রুটি বিচ্যুতি সংগঠিত হলেও তাকে অনেক বড় মনে করা হয়। সেহেতু কোরআনে কারীমে এ ধরনের ঘটনাবলীকে অপরাধ ও পাপ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

অতঃপর হযরত আদম (আ.) এর ভূল সম্পর্কে তফসীর বিদগন বহু কারণ বর্ণনা করেছেন এবং বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যথা :

* হযরত আদম (আ.) কে যখন নিষেধ করা হয়েছিল তখন একটি নির্দিষ্ট গাছের প্রতি ইঙ্গিত করেই তা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে শুধু মাত্র সে গাছটিই উদ্দেশ্য ছিল না। বরং সে জাতীয় যাবতীয় গাছও এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। কিন্তু হয়ত হযরত আদম (আ.) এর এ ধারণা হয়েছিল যে, যে গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে নিষেধ করা হয়েছিল, উক্ত নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র ঐ বিশেষ গাছটিতেই সীমাবদ্ধ। ঐ জাতীয় অন্য যে সমস্ত গাছ গুলো আছে তার কাছে যাওয়াতে এবং ফল খাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই। এজন্য তিনি ঐ ইঙ্গিত কৃত গাছ থেকে বিরত ছিলেন এবং ঐ জাতীয় অন্য কোন গাছের ফল খেয়ে ফেলেন।

* এমনও হতে পারে যে, শয়তান তাঁর অন্তরে এ প্রবঞ্চনা সঞ্চারিত করেছিল যে, এ গাছ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টির সূচনা লগ্নের সাথে সম্পৃক্ত, পরবর্তী সময়ের জন্য সেবিধি নিষেধ কার্য কর নয়।
এখানে সম্ভাব্য আরো যে সমস্ত ব্যাখ্যা হতে পারে বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী তাহল নিম্নরূপঃ

হযরত আদম (আ.) থেকে ভূল সংঘটিত হওয়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা ফরেশতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেনঃ
انی جاعل فی الارض خليفة - الآية
“নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি প্রেরণ করব”। (সূরা বাকারা-৩০)

উক্ত ভাষ্য থেকে যে বিষয়টি বোধগম্য হয় তাহল, আদম (আ.) কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষন এটা আল্লাহ তায়ালারই ইচ্ছার অভিপ্রায়, এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানব জাতীর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন । তাছাড়া আল্লাহ পাক এ সম্পর্কে অন্য এক আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন :

فنسي ولم نجد له عزما
অর্থাৎ, আদম আমার নির্দেশ ভুলে গেল, এবং আমি তাঁতে সংকল্পের দৃঢ়তা পায়নি৷

এতে করে একথাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত আদম (আ.) ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহর নাফরমানী করেননি, বরং তাঁর ভূল হয়ে গিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালাত ইচ্ছা করলে অন্য কোন ভাবেও পৃথিবীতে মানব সৃষ্টি করতে পারতেন, তবে কেন এই উপায়ে তিনি পৃথিবীতে মানব জাতীর সূচনা ঘটালেন।


উত্তর : সমগ্র মানব জাতীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। কেননা এতে সমগ্র মানব জাতীর জন্যে বিরাট শিক্ষ্যণীয় বিষয় রয়েছে। আর তাহল, একটি মাত্র ভূলের কারণে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা হযরত হাওয়া (আ.) উভয়ের শাস্তি হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভূলের কারণে তাঁদেরকে জান্নাত থেকে বাহিষ্কার করা হয়েছে। অতএব প্রত্যেক আদম সন্তানকেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে জীবন যাপন করতে হবে। আল্লাহর নাফরমানী থেকে সর্বদা বিরত থাকতে হবে এবং সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের পূর্ণ আনুগত্য এবং ফরমাবরদার থাকতে হবে।


প্রিয় পাঠক! এবার আমরা জেনে নেব। পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বে হযরত আদম (আ.) জান্নাতে কতক্ষণ সময় ছিলেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আদম (আ.) আছরের সময় থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় জান্নাতে ছিলেন। হযরত হাসান (র.) বর্ণনা করেনঃ এর একটি ঘন্টা দুনিয়ার একশত ত্রিশ বছরের সমান ছিল।

হযরত আদম (আ.) এবং হাওয়া (আ.) থেকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভুল সংঘটিত হল, এরপর আল্লাহ পাকের পক্ষ্য থেকে হুকুম হলো : তোমরা নীচে নেমে যাও, জান্নাতে বসবাস আর নয়, বরং জান্নাত থেকে জমিনে চলে যাও। অতঃপর এই হুকুমের বাস্তবায়ন হলো, আদম (আ.) অবতরণ করলেন, সরদীপে (যাকে বর্তমানে শ্রীলংকা বলা হয়) আর হাওয়া (আ.) অবতরণ করলেন, আরব দেশের জেদ্দায়।

আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) এর একটি বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, হযরত আদম (আ.) সাফা পাহাড়ের উপর এবং হযরত হাওয়া (আ.) মারওয়াহ পাহাড়ের উপর অবতরণ করেন।

জান্নাত থেকে বের হয়ে পৃথিবীতে অবতরণের পর হযরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) এর অবস্থা কি হয়েছিল তার বিবরণে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বর্ণনা করেন, হযরত আদম (আ.) এবং হাওয়া (আ.) বেহেশত থেকে বের হওয়ার পর চল্লিশ বছর যাবত কিছুই পানাহার করেননি, আর লজ্জার কারণে তিনশত বছর যাবত উপরের দিকে মাথা তোলেন নি, এই দীর্ঘ সময় তাঁরা আল্লাহ পাকের মহান দরবারে ক্রন্দনরত ছিলেন।

হযরত আদম (আ.) তাঁর একটি মাত্র ভুলের জন্যে কত কান্না-কাটি করেছিলেন, ইমাম রাজী (রহ.) তফসীরে কাবীরে তার একটি বিবরণ পেশ করেছেন, এ প্রসঙ্গে তিনি একখানি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এরশাদ করেছেন, যদি সারা দুনিয়ার মানুষের কান্না-কাটিকে হযরত দাউদ (আ.) এর কান্না কাটির সম্মুখে একত্রিত করা হয়, তবে হযরত দাউদ (আ.) এর কান্না-কাটি অধিক হবে। আর যদি সারা দুনিয়ার মানুষের ক্রন্দন এবং হযরত দাউদ (আ.) এর ক্রন্দনকে একত্রিত করে হযরত নূহ (আ.) এর ক্রন্দনের পাশাপাশি রাখা হয়, তবে হযরত নূহ (আ.) এর ক্রন্দন অধিকতর প্রমাণিত হবে। আর যদি সারা দুনিয়ার মানুষের ক্রন্দন এবং হযরত দাউদ (আ.) ও নূহ (আ.) এর ক্রন্দনকে একত্রিত করা হয়, অতঃপর হযরত আদম (আ.) তাঁর একটি ভূলের জন্যে যে ক্রন্দন করেছিলেন, তার সম্মুকে রাখা হয়, তবে হযরত আদম (আ.) এর ক্রন্দনই অধিকতর হবে।


আমাদের জন্য শিক্ষা : উক্ত আলোচনা থেকে আমাদের জন্য যে বিষয়টি শিক্ষণীয় তাহল, সর্বদা সর্বপ্রকার পাপ থেকে বিরত থাকা, আর যদি কখনো ভূলেও কারো থেকে কোন পাপ সংঘঠিত হয়ে যায়, তাহলে উহা মাফের জন্য অধিক থেকে অধিক তওবা এস্তেগফার করা এবং ক্রন্দন করা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url