ইসলামের দৃষ্টিতে পোশাকের গুরুত্ব।

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পোশাক হল একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য বস্তু। আর এটা বাস্তব সত্য যে, পোশাক মানুষের জীবন যাপন, চালচলন, দ্বীন ধর্ম, আমল আখলাকের উপর অনেক বড় ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কোরআন-হাদিসের মধ্যেও এই সমস্ত বিষয়ের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। আদিকাল থেকে একটি প্রবাদ বাক্য মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ যেমন- (الناس باللباس) অর্থাৎ “মানুষের পরিচয় হল তার পোশাকে” কিন্তু বর্তমান যুগে ফ্যাশনের নামে যে সমস্ত পোশাক বের করা হচ্ছে সেগুলোতে পর্দা করার পরিবর্তে সুকৌশলে মানুষকে উলঙ্গ করে তুলে ধরা বৈ আর কিছুই উদ্দেশ্য নয়। বর্তমানে এসকল পোশাক পরিধান করে মানুষ তাদের আসল পরিচয় বের করতে ভুলে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে তাদের ব্যক্তি মর্যাদা ও ইজ্জত- আব্রুর কথা। অথচ ইসলাম নারী ও পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পোশাকের বর্ণনা দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ধর্মে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তাই আসুন আমরা তদানুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালিত করি।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-১১


পোশাকের মূল বিষয়বস্তু

ঈমানের পরে সর্বপ্রথম ও দায়েমী ফরয হলো সতর সমুহ আবৃত রাখা। যার উপর আমল করা অতীব জরুরী । আর এই সতর সমুহ আবৃত রাখা সকল নবীগণের শরীয়তে ফরজ ছিল। শরীয়তের নিয়ম নীতি নির্ধারণ হওয়ার পুর্বে যখন জান্নাতের নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার কারণে হযরত আদম এবং হযরত হাওয়া (আঃ) এর সতর খুলে গিয়েছিল, তখনো হযরত আদম এবং হযরত হাওয়া (আঃ) সতর খুলাটাকে পছন্দ করেন নাই। এই জন্য তারা উভয়ে জান্নাতের গাছের পাতা দ্বারা নিজেদের সতর কে ঢেকে নিয়েছিলেন।

হযরত আদম (আঃ) দুনিয়াতে আসার পর থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক পয়গম্বরের শরীয়তে সতর ঢাকা ফরয করা হয়েছিল। যদিও সতরের পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারে মতানৈক্য দেখা গিয়েছে।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-১৮


পোশাক পরিধানের মূলনীতি

কোরআন হাদিস রিসার্চ করে পোশাক পরিধানের যে সমস্ত মূলনীতি পাওয়া যায়, সেই মূলনীতিগুলো হল, শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে। অতএব কোন ব্যক্তির জন্য সেই মূলনীতিসমুহের উপর অতিরঞ্জিত করা কখনোই ঠিক হবে না। কেননা সে গুলি শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত এবং সেগুলির মধ্যে মানুষের কল্যাণ নিহিত।

যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন অর্থ: "হে বনী আদম আমি তোমাদের জন্য এমন পোশাক অবতীর্ন করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে। এবং অবতীর্ন করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং পরহেযগারীর পোষাক এটি সর্বোত্তম এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন।” উপরোক্ত আয়াতে তিনটি বাক্য উল্লেখ করা হয়েছে বাক্য গুলির মধ্যে পোশাক পরিচ্ছেদের সমস্ত মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে সেই সমস্ত মুলনীতি সবিস্তারে নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-২১


মূলনীতি ১: পোশাক এত ছোট, চাপা, পাতলা না হওয়া যার কারণে তার অঙ্গ সমূহ প্রকাশ পায় অর্থাৎ পোশাকের দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষ যেন তার দ্বারা গোপন এবং লজ্জাস্থান সমুহ আবৃত করতে পারে কিন্তু যে পোশাক সে ধরণের না হয়ে অন্য ধরণের হয়, তা মূলত পোশাক না। সে সমস্ত বস্ত্র আমাদের পরিহার করা উচিত।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-২২


মূলনীতি ২: পোশাক পরিধানকারী কাফের মুশরিকদের পোশাকের অনুসরণ করবেন না। অর্থাৎ পোশাক পরিধান কারী ব্যক্তি অবশ্যই কোন কাফের মুসরিকদের পোশাকের মত পোশাক পরবে না। তাদের অনুসরন করা নাজায়েয এবং হারাম এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে অনেক কঠিন হুশিয়ারী এসেছে। যেমন রাসুল (সা.) বলেছেন, অর্থাৎ “যে ব্যক্তি যে জাতির অনুসরন করবে সে তাদের মধ্য থেকে হবে।”

-মরদু কি লিবাস: পৃষ্ঠা নং-২৩


মুলনীতি ৩: যে সমস্ত পোশাক পরিধান করলে অহংকার আসে সেই সমস্ত পোশাক থেকে পরহেজ করা। অর্থাৎ আমাদের সমাজে এমন কিছু পোশাক রয়েছে যেগুলি পরিধান করলে মানুষের মাঝে অহংকারী ভাব চলে আসে, এবং এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা অহংকার বসত পোশাক পরিধান করে। সেই সমস্ত ব্যাক্তিদের উদ্দেশ্যে হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়ার মধ্যে অহংকার বসত পোশাক পরিধান করে, কেয়ামতের দিন তাকে ঐ পোশাক পরিহিত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।"

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা-২৭


মূলনীতি ৪: ধনী ব্যক্তি এমন পোশাক পরিধান করবে না যার ফলে দর্শক তাকে দেখে গরীব মনে করে। অর্থাৎ আমাদের সমাজে এমন মানুষ রয়েছে যাদের অনেক ধন সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কৃপণতা বসত নিম্ন মানের পোশাক পরিধান করে। যা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়, অথচ উচিৎ ছিল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে যে ধন সম্পদ দান করছেন সেগুলোর কৃতজ্ঞতা আপন করার জন্য কৃপণতা না করে উত্তম পোশাক পরিধান করা।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-২৮


মূলনীতি ৫: সামর্থের বাহিরে অতিরিক্ত মূল্যের পোশাক পরিধান না করা। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির জন্য সামর্থের বাইরে পোশাক পরা কোন ক্রমেই উচিত না। কারণ যদি কোন ব্যক্তি সামর্থের বাইরে অতিরিক্ত মূল্যের পোশাক পরে তাহলে সেটা অপচয়, অহংকারের কারণ বনে যায়। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, “যা চাও খাও যা চাও পরিধান কর কিন্তু দুটি জিনিস থেকে বিরত থাকো (১) অপচয় (২) অহংকার। উপরোক্ত হাদিসের উদ্দেশ্য হলো, যে রকম ইচ্ছা কাপড় পরিধান করো তোমাদের জন্য তা জায়েয আছে। কিন্তু তাতে যেন অপচয় না হয়, আর অপচয় তখনই হয় যখন মানুষ তার স্তর থেকে উপরের স্তরের পোশাক পরিধান করে। যা পরার দ্বারা অহংকার সৃষ্টি হয়। এই জন্যে এর থেকে বিরত থাকা উচিত।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা-৩০


মুলনীতি ৬: পুরুষের জন্য সেলোয়ার, পায়জামা, লুঙ্গি এত নিচে না পড়া যার ফলে পায়ের টাখনু ঢেকে যায়। অর্থাৎ সেলোয়ার কামিজ পড়ার মধ্যে সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত যাতে করে কোন ভাবেই পোশাক টাখনুর নিচে চলে না যায়। কেননা হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে হযরত আব্দুলাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হুজুর পাক (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার পোশাককে অহংকারের সাথে টা খনুর নিচে পড়ে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। অন্যত্র বর্ণিত আছে,” যদি কোন পুরুষের জামা তার টাকনুকে ঢেকে নেয় তাহলে ঐ ঢাকা অংশটুক জাহান্নামে যাবে।” এই সমস্ত হাদিস থেকে স্পষ্ট ভাবে বুঝা গেল যে, পুরুষের জন্য সেলোয়ার, পায়জামা লুঙ্গি ইত্যাদি টাকনুর নিচে পড়া কখনই জায়েয নেই বরং গুনাহের কাজ। অতএব সেই সমস্ত বিষয় থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

-মরদু কি নিবাস পৃষ্ঠা নং-৩১


মূলনীতি ৭: ও পুরুষ রেশমী পোশক পড়িধান করবে না। কারণ পুরুষের জন্য রেশমী পোশাক পরিধান করা হারাম। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ” আমার উম্মতের পুরুষ সমাজের জন্য সোনা এবং রেশম হারাম করা হয়েছে এবং মহিলাদের জন্য হালাল করা হয়েছে।"

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-৩৪


মূলনীতি ৮: পোশাক পরিস্কার হতে হবে আর পুরুষের জন্য সাদা পোশাক পরিধান করা অতি পছন্দনীয়। যেমন হযরত আব্দুলাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হুজুর (সা.) বলেছেন, “সাদা রঙের পোশাক পরিধান কর কেননা সাদা রঙের পোশাক পরিধান করা পুরুষের জন্য উত্তম।” এই হাদিস থেকে বুঝা গেল হুজুর পাক (সা.) পুরুষের জন্য সাদা পোশাক পছন্দ করেছেন। অবশ্য অন্য রঙের পোশাক পরিধান করাও জায়েয আছে।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-৩৪


মুলনীতি ৯: খালেস লাল পোশাক পরিধান করা পুরুষের জন্য জায়েয নেই, এই রকম ভাবে যে পোশাক মহিলাদের পোশাকের সাথে মিলে যায় সেগুলো পড়াও জায়েয নেই। কারণ তার সাথে মহিলার সাদৃশ্য হয়ে যায়।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-৩৫


মুলনীতি ১০: পুরুষ মহিলাদের পোশাক পরবে না এবং মহিলা পুরুষদের পোশাক পরবে না। হযরত আবু হোরায়রা থেকেবর্ণিত, হুজুর পাক (সা.) ঐ সব পুরুষের উপর লানত করেছেন যারা মহিলাদের পোশাক পরিধান করেন এবং ঐ সব মহিলাদের উপর লানত করেছেন যারা পুরুষের পোশাক পরিধান করে।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-৩৬


উপরোক্ত উসূল সমূহ মেনে চললে সেটাই হবে শরীয়তের লেবাস।


পোশাক কি রকম হওয়া উচিত

ইসলাম হল শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। ইসলাম মানুষকে তার স্ব-অবস্থায় রেখে তার জন্যে কোনটি কল্যাণ কোনটি অকল্যাণ সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শিক্ষা দিয়েছে। যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে একই ধরণের পোশাক পড়তে হবে, তার বাইরে কোন পোশাক পরতে পারবে না। এটা ইসলাম কখনোই বলেনি। মানুষের প্রয়োজন অনুসারে তাদেরও পোশাক পরিধানের সুযোগ দিয়েছে। যেমন কখনো পাতলা, কখনো মোটা ইত্যাদি কিন্তু শর্ত হল পোশাকের ব্যাপারে ইসলাম যে সমস্ত বুনিয়াদি মুলনীতি বর্ণনা করে দিয়েছে সেই সমস্ত মুলনীতির প্রতি লক্ষ রাখা প্রত্যেক অবস্থায় জরুরী। তাহলেই সুন্নতের উপর জীবন যাপন করা আমাদের উপর সহজ হবে।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-১৯


টুপি

টুপি হল মুসলিম জাতির শিয়ার। টুপি পরে নামাজ পড়া হলো সুন্নত। এখন কথা হল টুপি কি রকম হওয়া উচিত ? এ বিষয়ে এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাসূল (সা.) এর পক্ষ থেকে তিন প্রকারের টুপি পড়া সাবেত আছে। (১) যা মাথার সাথে মিলে থাকে (২) যা মাথার থেকে সামান্য পরিমাণ উঁচু ছিল। (৩) উপরে উল্লেখিত দুই প্রকারের মতই ছিল কিন্তু টুপিটি বড় এবং খোলা ছিল যার দ্বারা কান পর্যন্ত ঢেকে যেত। অতএব এ সমস্ত প্রকারের টুপি পড়া জায়েয আছে। আর আমাদের সমাজে যে সমস্ত টুপির প্রচলন রয়েছে গেণ সমস্ত টুপি দ্বারাও সুন্নত আদায় হবে। সুতরাং টুপি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা শরীয়তকে কঠিন করা ছারা আর কিছুই না। যার কারণে সাধারণ মানুষ সুন্নত চিনতে বিভ্রান্তির মুখে পড়ে যাবে। যা নিতান্তই দুঃখজনক একটা বিষয়।

-মরদু কি লিবাস পৃষ্ঠা নং-৫৫


পাগড়ী পড়া

পাগড়ী পরা রাসূল (সা.) ও সাহাবা কেরাম (রা.) থেকে সাবেত আছে। এ জন্যে পাগড়ী পরা সুন্নত। অনেকের ধারণা যে, পাগড়ী হলো নামাজের সুন্নত, মূলত তাদের ধারণা ঠিক না। কেননা রাসূল (সা.) পোশাকের সাথেই পাগড়ী পরতেন। এতে বুঝা গেল পাগড়ীর সুন্নত শুধু নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ জন্যে যদি কোন ব্যক্তি সুন্নতের অনুসরণ করে পাগড়ী পরে সে নিশ্বান্দেহে সওয়াবের অধিকারী হবে। আর যদি কোন ব্যক্তি পাগড়ী না পরে তাহলে সে গোনাহগার হবে না। কেননা হুজুর পাক (সা.) থেকে পাগড়ী পরা দায়েমী ভাবে সাবেত না।

-মরদু কি লিবাস : পৃষ্ঠা নং-৫৭


পাগড়ীর রং

পাগড়ী হলো পোশাকের সুন্নত। তাই পাগড়ী যে রঙেরই হোক না কেন তার দ্বারা সুন্নত আদায় হবে। কোন খাস রঙের পাবন্দি করার প্রয়োজন নেই। সেটা কালো হোক সাদা হোক প্রত্যেকটি সহীহ। হুজুর পাক (সা.) থেকে সাদা, কালো পাগড়ী পরা সাবেত আছে। নীল ও সবুজ পাগড়ী পরা সাবেত নেই। তবে এক রেওয়াতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে সবুজ পাগড়ী পরার কথা সাবেত আছে।

-মরদু কি লিবাস পৃষ্ঠা নং- ৬১/৬২

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url