ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স বা বীমা।

ইন্সুরেন্সের সংঙ্গা

ইন্সুরেন্স হলো এক ধরণের অর্থ লেনদেনের চুক্তি। বাংলায় যাকে বীমা ইংরেজীতে ইন্সুরেন্স এবং আরবীতে التامين বলে। ইন্সুরেন্সের আভিধানিক অর্থ হলো গ্যারান্টি দেওয়া, নিশ্চয়তা প্রদান করা। পরিভাষায় ইন্সুরেন্স হলো ক্রমিক চাঁদার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে বা তার আগে বীমাকারীর সম্পত্তিহানী বা মৃত্যু হলে মোটা টাকা পাওয়ার চুক্তি। এক কথায় বলা যায় ভবিষ্যতের খারাপ কিছু ঘটা থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য কিছু করা হলো বীমা।


বীমার শেকড় সন্ধানে

ইংরেজী ১৪ শতকের শুরুতে এর আবির্ভাব হয়েছে। তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সাগর পথে মালামাল প্রেরণ করা হতো। অনেক সময় জাহাজ ডুবে যেত। মালের ক্ষতি হতো। সামুদ্রিক জাহাজের ক্ষতি পুরণের জন্য বীমার সূচনা হয়। আল্লামা শামী (র.) নিরাপত্তার বিধান সংক্রান্ত আলোচনায় سوكرة নামে এই বীমার কথা উল্লেখ করেছেন।


والذي يظهر لي لا يحل للتاجر اخذ بدل العالم (٣:٢٤٩)


বীমার প্রকার

যে বিপদগুলোর বিপরীতে বীমা করা হয় সে বিপদগুলোর দিক লক্ষ করে বীমা তিন প্রকার।

১. জীবন বীমা

২. দ্রব্য সামগ্রীর বিপরীতে বীমা

৩. দায়-দায়িত্বের বিপরীতে বীমা


জীবন বীমা

ইংরেজীতে Life insurance এবং আরবীতে تامين الحياء বলা হয়। কোন ব্যক্তি তার জীবনের বিপরীতে বীমা করতে পারে। বীমা কোম্পানীর কাছে জীবন বীমার আবেদন পেশ করলে কোম্পানী তাদের ডাক্তার দ্বারা উক্ত ব্যক্তির পূর্ণ বডি চেকআপ করিয়ে নেয়। তার এমন কোন জটিল রোগ আছে কিনা যার কারণে তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে। যদি এরূপ কিছু না থাকে তাহলে উক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক ভাবে কত দিন বাঁচতে পারে এর অনুমান করা হয়। এবং সেই মেয়াদের জন্য তার বীমা করা হয়। যেমন কোন ব্যক্তির বীমার মেয়াদ আনুমানিক দশ বছর নির্ধারণ করা হলো। প্রত্যেক মাসে প্রিমিয়াম হলো একশ টাকা বছরে বারশ টাকা দশ বছরে জমা হয় বার হাজার টাকা । বীমা কোম্পানী এ কথা বলে যে, এই দশ বছরের মধ্যে যদি তোমার মৃত্যু হয় তাহলে দশ বছর পূন্য হওয়ার পর আমরা তোমার স্ত্রী সন্তান এবং তোমার উত্তরাধীকারিদের দশ লাখ টাকা দেব। আর যদি তোমার মৃত্যু না হয় এবং দশ বছর পূন্য হয়ে যায় তাহলে তোমার জমা বার হাজার টাকা সুদ সহ যা লাভ হয় তা তোমাকে দিয়ে দেওয়া হবে। এটাকে লাইফ ইন্সুরেন্স বলে।


ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে জীবন বীমা

প্রিমিয়াম হিসাবে সে বার হাজার টাকা যা জমা করেছে, তা সংরক্ষিত রয়েছে। এবং নিশ্চিত ভাবে সে এ টাকা পাবে। এ কারণে এটাকে تعليق التمليك على الخطر বলা যাবে না। কারণ এক পক্ষ থেকে আদায় করা হলো নিশ্চিত এবং অপর পক্ষ থেকে আদায় করা অনিশ্চিত বিষয়টি এমন নয়। বীমাকারী যে বার হাজার টাকা জমা করেছে বীমা কোম্পানী তা নিশ্চিত ভাবে আদায় করে দিবে। তবে সুদ সহ যে লাভ হবে তা সম্পূর্ন ভাবে হারাম হবে। বার হাজার যা পাবে তাতে জুয়া নেই তবে তাতে প্রতারণা রয়েছে।

প্রতারণা বলার কারণ হলো সে জানে না যে সে কি বার হাজার পাবে না দশ লাখ পাবে। যদি সে এই দশ বছরের মধ্যে মারা যায় তাহলে দশ লাখ পাবে। আর যদি মারা না যায় তাহলে বার হাজার পাবে। সুতরাং এই পরিমাণ নির্দিষ্ট নয়। এ কারণে প্রতারণা বলা যায়। জুয়া বলা যায় না। বার হাজারের বিপরীতে দশ লাখ এটা নিশ্চিত ভাবে প্রতারণা। এতে সুদ ও প্রতারণা উভয়ই পাওয়া যাচ্ছে সুতরাং জায়েয নেই।


দ্রব্য সামগ্রীর বিপরীতে বীমা

ইংরেজীতে Goods insurance এবং আরবীতে تامين الاشياء বলা হয়। গাড়ি, বাড়ি, ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদির বীমা এ শ্রেণীর অর্ন্তভুক্ত। দ্রব্য সামগ্রীর বীমা করার পদ্ধতি হলো বীমাকারী যে দ্রব্যের বীমা করতে চায়; বীমা কোম্পানী উক্ত দ্রব্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে যে সেটি স্বাভাবিক ভাবে কত বছর পর্যন্ত চলতে পারে। অতঃপর উক্ত সময়ের জন্য কোম্পানী এ মর্মে গ্যারান্টি প্রদান করে যে যদি এ মেয়াদের মাঝে উক্ত দ্রব্য নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা কোম্পানীর ব্যয়ে মেরামত করে দেয়া হবে কিংবা যদি সেটা কোন কারণে একেবারে নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে অনুরূপ একটি দ্রব্য কোম্পানী বীমাকারীকে ক্রয় করে দিবে। এ যাবৎ বীমাকারীকে ঐ নির্ধারীত মেয়াদ পর্যন্ত বীমা কোম্পানীর বরাবরে মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক কিংবা বাৎসরীক কিস্তিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করে যেতে হয়।

যদি নির্ধারিত সময়ের মাঝে উক্ত দ্রব্য নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে বীমা কোম্পানী তা মেরামত করে দেয় কিংবা তা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয়। আর যদি উক্ত দ্রব্য নষ্ট বা ধ্বংস না হয় তাহলে জমাকৃত টাকার বিনিময়ে কোম্পানী বীমাকারীকে কিছুই ফিরিয়ে দেখ না। এটাই হলো দ্রব্য সামগ্রীর বিপরীতে বীমা।


ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে দ্রব্য সামগ্রীর বিপরীতে বীমা

জমহুর ওলামাদের মতে দ্রব্য সামগ্রীর বিপরীতে বীমা নাজায়েয এবং হারাম। এক পক্ষ থেকে আদায় করা হলো নিশ্চিত এবং অপর পক্ষ থেকে পাওয়া হলো অনি শ্চিত। এবং তা معلق علي الخطر । যদি দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে সে পাবে আর যদি না ঘটে তাহলে পাবে না। সুতরাং এতে غرر এবং জুয়া রয়েছে।


দায়-দায়িত্বের বিপরীতে বীমা

ইংরেজীতে Third party insurance এবং আরবীতে تامين المسؤليات বলা হয়। এর অর্থ হলো ভবিষ্যতে কোন ব্যক্তির উপর কোন আর্থিক ক্ষতিপূরণের দায়ভার চেপে বসতে পারে এ আশংকায় বীমা করা। যেমন কোন ব্যক্তি রোডে পাড়ি নামাবে। এ গাড়ি একসিডেন্ট করার কারণে যদি কোন ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে তাহলে গাড়ির মালিককে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এজন্য গাড়ির মালিক গাড়ির বিপরীতে বীমা করে রাখেন এবং নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে যান। যদি উক্ত গাড়ি একসিডেন্ট করে কারো প্রাণহানি ঘটায় তাহলে বীমা কোম্পানী তার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয়। আর যদি এরূপ কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে বীমাকারী জমাকৃত টাকার কিছুই ফেরৎ পায় না। এটাকে দায়-দায়িত্বের বিপরীতে বীমা বলে।


ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে দায়-দায়িত্বের বিপরীতে বীমা

জমহুর ওলামাদের মতে দ্রব্য সামগ্রীর বিপরীতে বীমা নাজায়েয এবং হারাম এক পক্ষ থেকে আদায় করা হলো নিশ্চিত এবং অপর পক্ষ থেকে পাওয়া হলো অনি শ্চিত। এবং তা معلق على الخطر। যদি দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে সে পাবে আর যদি না ঘটে তাহলে পাবে না সুতরাং এতে غرر এবং জুয়া রয়েছে।


বীমা কোম্পানীর শ্রেনীভেদ

কর্ম পদ্ধতি ও গঠন প্রনালী হিসাবে বীমা

১. কমার্শিয়াল বীমা।

২. পারস্পরিক সহযোগিতা বীমা।


কমার্শিয়াল বীমা

এর পদ্ধতি হলো, বীমা কোম্পানী বীমার মাধ্যমে ব্যবসা করার জন্য স্থাপন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য বীমার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। যেমন অন্যান্য কোম্পানী বিভিন্ন কারবার দ্বারা লাভবান হয়। এ কোম্পানী বিভিন্ন প্রকার বীমার স্কীম চালু করে। যে বীমার গ্রাহক হতে চায় তার সঙ্গে বীমা কোম্পানীর চুক্তি হয় যে, এই পরিমাণ টাকার এতগুলো প্রিমিয়াম আদায় করবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোম্পানী আপনার ক্ষতিপূরণ করবে। কোম্পানী প্রিমিয়াম নির্ধারণ করার জন্য হিসাব করে নেয় যে দুর্ঘটনার বিপরীতে বীমা করা হচেছ তা কত বার হওয়ার সম্ভাবনা রাখে? যেন তার বিনিময় পরিশোধ করে কোম্পানীর লাভ থাকে। এটা হিসাবের জন্য একটি ভিন্ন বিষয় আছে। এ বিষয়ের পন্ডিতকে একচুরি বলে। এ ধরণের বীমার প্রচলনই বেশি।


ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কমার্শিয়াল বীমা

ধর্মীয়, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির দিক বিবেচনা করে বর্তমান কালের ফিকাহবিদরা কমার্শিয়াল বীমাকে সম্পূর্ণরুপে নাজায়েয ও হারাম বলে ঘোষণা করেছেন।


কমার্শিয়াল বীমা হারাম হওয়ার কারণ

১. কমার্শিয়াল বীমায় ربما الفضل বা অধিক প্রদান জনিত সুদ ও ربا النسية বা সময়ের ব্যবধান জনিত সুদ দুটোই বিদ্যমান রয়েছে। কেননা বীমাকারী যত টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে জমা দান করে; ক্ষতিপূরণ হিসাবে যদি তাকে তার চেয়ে অধিক পরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয় তাহলে এটি ربا الفضل বলে গণ্য হবে। অপর পক্ষে বীমাকারী যে সময় টাকা প্রদান করে ক্ষতিপূরণ হিসাবে তাকে বা তার উত্তরাধিকারীদেরকে যে টাকা দেওয়া হয়; তা সেই সময়ের অনেক পরে পরিশোধ করা হয়। ফলে এটি ربا النسية হয়ে যায়।

২. বীমা এমন ধরণের চুক্তি, যে চুক্তিতে কখনো কখনো এক জনের মাল বিনা বিনিময়ে শুধুমাত্র শর্তের কারণে অন্যজন লাভ করে থাকে। আর ব্যবসায়ী চুক্তিতে অন্যের মাল বিনা বিনিময়ে গ্রহন করা হারাম। কেননা এটি স্পষ্ট সুদ।

৩. বীমার চুক্তিতে ক্ষতি না করেই কিংবা ক্ষতির কারণ না হয়েই বীমা কোম্পানীকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকতে হয়।


পারস্পরিক সহযোগিতা বীমা

একই ধরণের ক্ষতির আশংকা সম্বলিত ব্যক্তিরা মিলে একটি ফান্ড এই উদ্দেশ্যে গঠন করে থাকেন যে, সদস্যদের কেউ যদি কোন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে এই ফান্ড থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। অবশ্য কি ধরণের দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং সর্বোচ্চ কত টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে নির্ধারিত কতিপয় বিধি-বিধানের আওতায় এ ফান্ড পরিচালিত হয়। এ ফান্ডে কেবলমাত্র সদস্যদের প্রিমিয়াম জমা নেয়া হয় এবং সদস্যদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকেই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।

বৎসরান্তে হিসাব করে যদি দেখা যায় যে, ক্ষতিপূরণ দেয়ার পর টাকা অবশিষ্ট রয়েছে তাহলে সে টাকা সদস্যদের মাঝে বন্টন করে দেয়া হয় কিংবা ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখা হয়। আর যদি জমাকৃত টাকার চেয়েও অধিক টাকা ক্ষতিপূরণ হিসাবে বরাদ্ধ করতে হয় তাহলে অতিরিক্ত টাকা সদস্যদের থেকে আদায় করা হয়।


ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে পারস্পরিক সহযোগিতা বীমা

সকল ওলামায়ে কিরামের মতে পারস্পরিক সহযোগিতা বীমা জায়েয। পারস্পরিক সহযোগিতা বীমা হল পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অনুদান। তবে শর্ত হলো আনুসাঙ্গিক ক্ষেত্রে সুদের কোন প্রক্রিয়ার সাথে এটিকে জড়িয়ে ফেলা যাবে না। এই ফান্ডের টাকা যদি হলাল খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করা হয় তাতে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি ফান্ডের টাকা অবৈধ খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করা হয় অথবা সুদের ভিত্তিতে লোন দেয়া হয় তাহলে তা হারাম হয়ে যাবে।


বীমার ব্যাপারে বর্তমান ওলামাদের ফাতওয়া

বর্তমান ওলামায়ে কিরাম ফাতওয়া দেন যে সরকারের পক্ষ থেকে যে বীমা করা আবশ্যক অথবা যে বীমা না করলে তার প্রয়োজন পুরা করা সম্ভব নয় তাহলে ঐ জিনিষের উপর বীমা করা যেতে পারে। থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স করা ছাড়া যদি রাস্তায় গাড়ী চালানো না যায় তাহলে থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স করা যেতে পারে। তবে থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সকারী যে বিনিময় পায় সে শুধু ততোটুকো বিনিময় উসুল করবে যতটুকো সে প্রিমিয়াম আদায় করেছে। তার চেয়ে বেশি বিনিময় গ্রহন করার অনুমতি নেই।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url