শরিয়তের দৃষ্টিতে শেয়ার ব্যবসা।
আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সৃষ্টিকে আপন মহিমায় অত্যন্ত সুন্দর করে গড়ে তোলেছেন। আর পৃথিবীকে করেছেন মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নিবাস। যুগে যুগে নবী-রাসূল ও সত্য ধর্ম দিয়ে মানুষের হেদায়াতের ব্যবস্থা করেছেন। তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত হতে নাযিল করেছেন আসমানী গ্রন্থ। এরই ধরাবাহিকতায় মহাগ্রন্থ কুরআন নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট রাসূল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যিনি মানব জাতির জন্য পুর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে রেখে গেছেন শান্তির ধর্ম ইসলামকে। যে ধর্মে নিত্য যাপিত জীবনের সকল সমস্যার সমাধান বিদ্যমান। সুচারুরুপে মানুষের জীবন চলার যাবতীয় আহকাম যাতে বর্ণিত হয়েছে সুস্পষ্ট ভাবে। পাশাপাশি অনাগত সমস্যা ও আধুনিক মাসায়েলের বিধান বর্ণনা করার জন্য মৌলিক নীতিমালাও যার ভাণ্ডারে মজুদ আছে। এমনই এক নতুন ও ব্যাপক বিস্তৃত বিষয় হচ্ছে শেয়ার বাজার।
শেয়ার বাজারের পরিচয়
আল্লাহ তায়ালা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায় ভাবে ভোগ না করার জন্য কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। যেমনটি কুরআনের উপরোল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক ভাবে অর্থ লেনদেন তথা পণ্যসামগ্রী বেচা-কেনার মাধ্যমে একে অপরের সন্তুষ্টি চিত্তে আদান প্রদানকে মানুষের জন্য জায়েয করে দিয়েছেন। ফলে ব্যবসার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। মানুষ অর্থকে পুঁজি করে চাহিদার বস্তু ক্রয় বিক্রয়ে আত্মনিয়োগ করেছে। এর দ্বারা একদিকে যেমন পৃথিবীর নেযাম সুন্দর ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষও লাভবান হচ্ছে তার পুঁজি বিনিয়োগ ও কারবার দ্বারা। তবে বাণিজ্যের জন্য যে মূলধন প্রয়োজন হয় তার উৎস হতে পারে তিনটি।
উৎস তিনটি নিম্নরুপ
(ক) যে ব্যক্তি ব্যবসা করতে আগ্রহী তার অর্থ।
(খ) ব্যাংক ঋণ বা করজকৃত অর্থ।
(গ) সাধারণ বিনিয়োগকারী।
মূলধন যোগাড়ের সর্বশেষ উৎসটিই হলো শেয়ার বাজারের ক্ষেত্র। কারণ সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যে অর্থ গ্রহণ করে পুঁজি একত্র করে, সে অংশিদারিত্বের বিষয়টিই হলো শেয়ার শেয়ার বাজারে এ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশিদার হয়। এ ক্ষেত্রে সে তার শেয়ার মূল্যের সমপরিমাণ মালিকানা অর্জন করে। অংশিদার হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানের লাভ লোকসান সবগুলোতে সে তার শেয়ার পরিমান অংশিদার বলে গণ্য হয়।
মজার কথা হলো, এ ভাবে অংশিদার হওয়ার বিষয়টি স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্রয় বিক্রয়ের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যার দরুণ চাইলেই সেখান থেকে শেয়ার ক্রয় করা যায় এবং প্রচলিত বাজার মূল্যে বিক্রিও করা যায়। তবে এর ক্রয় বিক্রয়ের জন্য শেয়ার সংক্রান্ত বিবরণ সম্বলিত কাগজপত্র আদান প্রদান করা হয় স্টক একচেঞ্জে এ কাগজই ক্রয় বিক্রয় করা হয়।
মৌলিক ব্যাখ্যা
শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি মোহাম্মদ তাকী উসমানী দা.বা. তার “ইসলাম আওর জাদীদ মায়ীশত ও তিজারত' গ্রন্থে এ বিষয়ে যা আলোকপাত করেছেন। তার সারাংশ হল, কেউ শেয়ার নিয়ে কোন কোম্পানীর অংশিদার হয়ে গেলে যে কোন মুহুর্তে টাকা ফেরত নেয়া পূর্বক সে অংশিদারিত্ব বাতিল করতে পারেনা। বরং কোম্পানীর অস্তিত্ব ঠিকে থাকা পর্যন্ত টাকা ফিরিয়ে নেয়া যায়না। কিন্তু অনেক অংশিদার যেহেতু এমনটি চায় তাই এরকম জিম্মাদারী সৃষ্টি করা আবশ্যক ছিল; যেন প্রয়োজনের সময় অংশিদার তার শেয়ারকে নগদে রূপান্তরিত করতে পারে। এ চাহিদা মিটানোর জন্যই শেয়ার বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেননা শেয়ার বাজারে অংশিদার কোম্পানীর কাছ থেকে তার পুঁজি ফেরত না আনতে পারলেও নিজের অংশ অন্যের কাছে বিক্রি করতে পারে। এর দ্বারা দ্বিতীয় ক্রেতা প্রথম ক্রেতার স্থলে কোম্পানীর অংশিদার হয়। আর প্রথম ক্রেতা তার পুঁজিকে নগদে পেয়ে যায়। যেখানে শেয়ার বেচাকেনা হয় একে শেয়ার বাজার বলা হয়ে থাকে।
শেয়ার বেচাকেনার দু'টি পদ্ধতি রয়েছে
(ক) কোন প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থতা ছাড়াই দু'জনে শেয়ার বেচাকেনা করবে। একে আরবিতে(عمليات من وراء المنصة) যাকে ইংরেজিতে বলে (over the coun ter transactions)
(খ) কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার বেচাকেনা করবে। এ প্রতিষ্ঠানটিকেই স্টক এক্সচেঞ্জ বলে। যার আরবি হলো (بورصة)।
এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারি অনুমতি ও পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। যা শুধু বিশ্বস্ত ও তালিকাভুক্ত (listed companies) কোম্পানীগুলোর শেয়ার বেচাকেনা করে থাকে। তবে অনেক কোম্পানী অস্তিত্ব লাভের পর আর অনেক কোম্পানী অনুমোদন পাওয়ার পর কারবার শুরু করার আগে তালিকাভুক্ত হয়। বাজারে শেয়ার ছাড়তে চাইলে কোম্পানীকে যেমন তালিকাভুক্ত হতে হয় পাশাপাশি বিনিয়োগকারীকেও স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনাবেচা করার জন্য ফি জমা দিয়ে সদস্য হতে হয়। সদস্য ছাড়া অন্য কেউ শেয়ার কিনতে চাইলে সদস্যের দালালীর মাধ্যমে কিনতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে।
এমনি ভাবে শেয়ার ক্রেতাও দু'ধরণের হয়ে থাকে।
(ক) যারা শেয়ার কিনে কোম্পানীর অংশিদার হয় এবং নিজের কাছে রেখে দিয়ে বছর শেষে তার মুনাফা অর্জন করে।
(খ) যারা শেয়ারকে ব্যবসার মাল মনে করে ক্রয় বিক্রয় করে। বেশিরভাগ অংশিদারই শেষোক্ত উদ্দেশ্যে শেয়ার বাণিজ্য করে থাকে । যার ফলে শুধু শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করাই আলাদা ব্যবসার রূপ ধারণ করেছে। এ শেয়ার বাজারের বেচাকেনার হুকুম নিয়েই আলোচনা করার প্রয়াস চালাবো ইনশাল্লাহ।
শেয়ার বেচাকেনার তিনটি পদ্ধতি রয়েছে
১. উপস্থিত ক্রয় বিক্রয়, যাকে ইংলিশে (spot sale) বলা হয়। এটি স্বাভাবিক ও সহজ পদ্ধতি। যার মধ্যে শেয়ারের মূল্যকে নগদে আদায় করা হয়। এ ক্রয় বিক্রয়েও শেয়ার সার্টিফিকেট সাধারণত এক সাপ্তাহ পর হস্তগত হয়ে থাকে।
২. ঋণের উপর ক্রয় বিক্রয় (sale on margin)। যাতে শেয়ারের মূল্য নগদে কিছু আদায় করা হয়। অবশিষ্ট টাকা বাকি থাকে।
৩. (short sale) শর্ট সেল। আর এটা হলো মালিকানা ছাড়া বিক্রয়ের নাম। অর্থ্যাৎ বিক্রেতা এমন শেয়ার বিক্রি করে দেয় যার মালিক সে এখনো হয়নি। বরং সে শেয়ার পাওয়ার ব্যাপারে আশান্বিত থাকে।
শেয়ার বেচাকেনার শর্তাবলী
শেয়ার বেচাকেনার জন্য নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাওয়া আবশ্যক। এ শর্তাবলী সাপেক্ষে শেয়ারের ক্রয় বিক্রয় জায়েয। যেমনটি ফকীহ কামাল উদ্দীন আহমদ রাশেদী (দা. বা.) তার জাদীদ তিজারত কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
-দ্রষ্টব্য: জাদীদ তিজারত ১০৩ ও ১১৫
(১) কোম্পানীর মূল কারবার হালাল হতে হবে। কেননা কোম্পানীর মূল ব্যবসা হারাম হলে তার শেয়ার কোন অবস্থাতেই জায়েয হবে না।
(২) অভিহিত মূল্যের (face value) চেয়ে কমবেশিতে বিক্রয়ের জন্য কোম্পানীর পণ্য কেবল নগদ না হতে হবে। অর্থাৎ কোম্পনীর আসবাবসামগ্রী কেবল নগদ ও ঋণের সুরতে না হলে শেয়ারকে নির্ধারিত মূল্যের কমবেশি করে বিক্রি করা হালাল হবে কিন্তু যে কোম্পানী বিল্ডিং, মেশিনারী ইত্যাদি কোন প্রকার জমাট বস্তু বা ব্যবসার পণ্য ক্রয় করেনি বরং তাতে শুধু নগদ অর্থ বা ঋণের টাকা আছে, তবে সে কোম্পানীর শেয়ারকে তার লিখিত মূল্যের কমবেশিতে বিক্রি করা জায়েয হবে না।
(৩) মাসিক বা বাৎসরিক কোন সুনির্দিষ্ট মুনাফা নির্ধারিত না হওয়া। বরং লভ্যাংশের শতকরা হার অনুযায়ী মুনাফা নির্ধারণ করা।
(৪) লাভ লোকসান উভয় ক্ষেত্রে কোম্পানীর সঙ্গে শরিক থাকা।
(৫) সুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানীর মূল ব্যবসা হালাল হওয়ার পরও তাদের ব্যবসা অন্যকোন ভাবে সুদের সাথে জড়িত হয়ে যায়। তাই বার্ষিক সাধারণ সভা (a.g.m) বা শেয়ার হোল্ডারদের মিটিংয়ে সুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। কোম্পানীর পরিচালক বরাবরে এ মর্মে প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করাও যতেষ্ট হতে পারে।
-ইমদাদুল ফতওয়া: ২/৪৯১