অ্যালকোহল যুক্ত ঔষধ বা অ্যালকোহল মিশ্রিত ঔষধ সেবন করা জায়েজ?

 


অ্যালকোহল নির্দিষ্ট এক ধরনের শরাব (মাদক) বিশেষ। অধিকাংশ এলোপ্যাথিক ঔষধের মধ্যে শতকরা ১% থেকে ২৫% পর্যন্ত এর মিশ্রণ করা হয়। এই প্রকারের ঔষধসমূহ সাধারণত সর্দি, কাশি, গলার খোস-পাঁচড়া ইত্যাদি সাধারণ রোগে ব্যবহার হয়ে থাকে। বলতে গেলে, এ রকম ঔষধের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই অ্যালকোহল মিশ্রিত।


অ্যালকোহল মিশ্রিত ঔষধের ব্যাপারটি এখন শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ইসলামী দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই আজ এই অবস্থার সম্মুখীন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন হয়- এ রকম ঔষধ ব্যবহারের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান কী?


এর জবাব বিশ্লেষণসাপেক্ষ। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতে, আঙ্গুর ও খেজুর ব্যতীত অন্য বস্তু দ্বারা তৈরী শরাব ঔষধ হিসেবে এতটুকু পর্যন্ত ব্যবহার  বৈধ-যতটুকু সেবনের মাধ্যমে নেশা না আসে।


আমাদের দেশের মধ্যে মিশ্রিত অ্যালকোহল বড় একটা অংশ আঙ্গুর ও খেজুর ব্যতীত অন্য বস্তু যেমন- চামড়া, গন্ধক, মধু, শিরা, শস্য এবং জব ইত্যাদি থেকে তৈরীকৃত। সুতরাং ঔষধসমূহের মধ্যে ব্যবহৃত অ্যালকোহল যদি আঙ্গুর ও খেজুর ব্যতীত অন্য বস্তু থেকে তৈরী হয়, তাহলে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতানুযায়ী এ জাতীয় ঔষধের ব্যবহার মাতলামী ও নেশাগ্রস্তে না পৌঁছা পর্যন্ত বৈধ।


কিন্তু যদি ওই অ্যালকোহল আঙ্গুর ও খেজুরের তৈরী হয়, তাহলে সেই ঔষধ ব্যবহারের কোনো সুযোগই নেই। বরং তা ব্যবহার করা নাজায়িয ও হারাম হবে। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তার এ কথা বলেন যে, এ রোগের জন্য এ ঔষধের বিকল্প অন্যকোনো ঔষধ নেই, তাহলে এমতাবস্থায় অন্তিম মুহূর্তে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সেই ঔষধ ব্যবহারের অবকাশ রয়েছে। আর তা এজন্য যে, এমতাবস্থায় হানাফী ইমামগণের মতানুযায়ী, হারাম বস্তু দ্বারা অপারগ অবস্থায় চিকিৎসা বৈধ ও জায়িয।


তবে ইমাম শাফিয়ী (রহ.)-এর মতে, নিরেট শরাব ঔষধ হিসেবে ব্যবহার সর্বাবস্থায় নাজায়িয ও অবৈধ। তবে হ্যাঁ, যদি শরাব কোনো ঔষধে এভাবে মিশ্রিত হয় যে, তদ্দ্বারা শরাবের হাকীকত ও বৈশিষ্ট্য একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এ ঔষধ দ্বারা এরকম উপকার অর্জন উদ্দেশ্য হয়, যা অন্যকোনো পবিত্র বৈধ ঔষধ দ্বারা অর্জন করা সম্ভবপর হয় না, তাহলে এমতাবস্থায় চিকিৎসা হিসেবে এ জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা জায়িয ও বৈধ হবে। তদ্রূপভাবে অন্যান্য অপবিত্র বস্তুরও একই বিধান। তবে তদ্দ্বারা ডাক্তারী শাস্ত্রের মাধ্যমে উপকার হওয়া প্রমাণিত হতে হবে অথবা কোনো ন্যায়পরায়ণ ডাক্তার কর্তৃক তদ্দ্বারা উপকার অর্জনের ব্যাপারে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং এ অপবিত্র বস্তু মিশ্রিত ঔষধের বিপরীতে এমন পবিত্র বস্তুর সন্ধান না থাকতে হবে, যা এ অপবিত্র ঔষধের ব্যবহার হতে বিমুখ করে দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও শুধু অ্যালকোহল ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করা যায় না। তা অন্য যে কোনো ঔষধে মিশ্রিত করে ব্যবহার করা যায়।


সুতরাং বুঝা গেলো ইমাম শাফেয়ী (রহ.)- এর মতে, অ্যালকোহল মিশ্রিত ঔষধ একান্ত ঠেকা বশতঃ চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা জায়িয ও বৈধ। অপরদিকে মালেকী ও হাম্বলী মাজহাবের বক্তব্য হানাফী মাজহাবের বক্তব্যের মতোই। অর্থাৎ অপারগতাবস্থা ব্যতীত অন্যকোনো অবস্থায় হারাম বস্তু দ্বারা চিকিৎসা নাজায়িয ও অবৈধ।


সারকথা, ঔষধে যে অ্যালকোহল মিশানো হয়ে থাকে, তা যদি আঙ্গুর ও খেজুর ব্যতীত অন্যকোনো বস্তু দ্বারা তৈরীকৃত হয়, তাহলে তা আমাদের ইমামন্বয় হযরত ইমাম আবু হানীফা ও হযরত আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতানুযায়ী যে পরিমাণ সেবনে নেশাগ্রস্ত হয় না, সে পরিমাণ ব্যবহার করার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু যতটুকু সেবনে নেশা আসে, সে পরিমাণ সেবন করা জায়িজ নয়।


আর যদি ওই অ্যালকোহল আঙ্গুর বা খেজুরের তৈরী হয়, তখন শুধুমাত্র সেই এলকোহল পৃথকভাবে ব্যবহার সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়িয ও অবৈধ। তবে হ্যাঁ, এ বৈজ্ঞানিক যুগে বিজ্ঞানের ফর্মুলা অনুযায়ী যদি কেমিক্যাল দ্বারা বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে তাকে অন্যান্য ঔষধের সাথে মিশানোর পর তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তখন সর্বসম্মতিক্রমে এরূপ ঔষধ ব্যবহার করা জায়িয ও বৈধ।


পক্ষান্তরে যদি ওই শরাব অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত না হয়, তবে প্রয়োজনবশত তা ব্যতীত যদি অন্য কোনো কার্যকরী ঔষধ পাওয়া না যায়, তাহলে কোনো অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ হিসেবে তার ব্যবহার জায়িয ও বৈধ হবে। কিন্তু তা দ্বারা নেশা জাগ্রত হলে, তার ব্যবহার নাজায়িয ও হারাম হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url