ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য

 

স্বামী স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা ও হৃদ্যতার মাঝেই গড়ে ওঠে সুখময় দাম্পত্য সংসার। আর এ জন্য তাদের একের অপরের প্রতি কর্তব্যের ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই পরিবারে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকবে-যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে হৃদয়ের টান ও ভালবাসা। এ জন্য এখানে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের আলোকে কিছু আলোচনা করছি।


স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পরিপূর্ণ দ্বীনদারী গ্রহণ করে তাদের দাম্পত্য জীবনকে মধুময় করে তুলবে। কেননা, দ্বীনদার জীবনেই রয়েছে প্রকৃত সুখ ও শান্তি। এ সম্পর্কে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-“মুমিন হয়ে যে পুরুষ ও নারী সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করবো এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রদান করবো। -সূরাহ নাহল, আয়াত : ৯৭


এভাবে পরিবারের সকলের দ্বীনদারীর দ্বারা ঘর হয়ে উঠে শান্তি-সুখের নীড়। যেমন, পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- “আল্লাহ্ তোমাদের গৃহকে করেছেন তোমাদের স্বস্তির আবাসস্থল।" -সূরাহ নাহল, আয়াত : ৮০


সেই সাথে এ দ্বীনদার জীবনের বদৌলতে তারা পরকালে জান্নাত লাভ করে সেখানে সুখের জীবন গড়ে তুলতে পারবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- “মুমিন হয়ে যে পুরুষ ও নারী সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও জুলুম করা হবে না।” -সূরাহ নিসা, আয়াত: ১২৪


এ জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কে তাদের পরিবার যাতে দ্বীনদার পরিবার হয় এবং তাদের সন্তানরা যাতে ধর্মপরায়ণ দ্বীনদাররূপে গড়ে উঠে, সেদিকে খুব খিয়াল রাখতে হবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার- পরিজনকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচাও।” -সূরাহ তাহরীম, আয়াত : ৬


এক্ষেত্রে সন্তানদেরকে ছোটকাল থেকেই দ্বীন পালনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এ সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- “ তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা নামাযের নির্দেশ দাও যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয়। আর নামায না পড়লে তাদেরকে প্রহার কর যখন তারা দশ বছর বয়সে পৌঁছে। আর তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও।” [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৬৭৫৬ ও সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৯৫]


স্বামী-স্ত্রীর চিন্তা করা প্রয়োজন যে, তারা দাম্পত্য জীবনে যা কিছু করবেন এবং কে কার হক কতটুকু আদায় করলেন- এ ব্যাপারে পরকালে মহান আল্লাহর নিকট হিসাব দিতে হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- পুরুষ তার পরিবার ও সংসারের জন্য দায়িত্বশীল, তাকে (কিয়ামতের দিন) তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর নারী তার স্বামীর ঘর ও সন্তান-সন্ততির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, দিন) তার তাকে (কিয়ামতের দিন) দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। " (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৫৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮২৮)


এ ভিত্তিতেই স্বামী-স্ত্রী পরস্পর একে অপরের হক ও অধিকার আদায় করে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবেন। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কর্তব্য হলো তাদের পরস্পরের একে অপরের প্রতি যে আমানত বিশ্বস্ততা, আস্থা বিশ্বাসের অঙ্গীকার আছে, তা কোনভাবেই যে ভঙ্গ না হয়। এ সম্পর্কে সতর্ক করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- “হে মুমিনগণ! জেনে-শুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানতের খিয়ানত করে বিশ্বাস ভঙ্গ করো না।" -সূরাহ আনফাল, আয়াত ২৭


তেমনি স্বামী-স্ত্রী পরস্পর একের অপরের প্রতি যে হক ও অধিকার রয়েছে, তা গুরুত্বের সাথে পালন করতে হবে। তাদের মৌলিকভাবে কী হক ও অধিকার রয়েছে, এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশা করেন-"জেনে রাখো, তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন হক রয়েছে, অনুরূপভাবে তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের হক রয়েছে। তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের হক হল, তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে যেতে না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর এবং তারা যেন তোমাদের ঘরের মধ্যে এমন কাউকে প্রবেশের অনুমতি না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর। আরও জেনে রাখো, তোমাদের উপর তাদের হক হল, তোমরা তাদের বস্ত্র ও পানাহার প্রভৃতি জরুরত পূরণের ব্যাপারে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে।” -জামি' তিরমিজী, হাদীস নং ১১৬৩



উপরে বর্ণিত স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য করণীয় কর্তব্য আদায়ের পাশাপাশি তাদের একের প্রতি অপরের যে সুনির্দিষ্ট। হক ও কর্তব্য রয়েছে, তাও তাদের যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্যসমূহের ব্যাপারে প্রথমে আলোচনা করা হচ্ছে।


স্ত্রীর নামায, রোযা প্রভৃতি পালনের পাশাপাশি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হলো- স্বামীর আনুগত্য করা বা তার কথামতো চলা। এটা নারীর জন্য ইহকালীন কল্যাণ লাভের সাথে সাথে পরকালীন সাফল্য লাভেরও মাধ্যম হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- "যখন নারী তার দায়িত্বের পাঁচওয়াক্ত নামায আদায় করবে, এটি দায়িত্বের (রামাজান) মাসের রোযা পালন করবে, তার লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে- তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা হয় সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর।” -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৬৬১


সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামী শরীয়ত বিরোধী বা আল্লাহর নাফরমানীর কাজের আদেশ না দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার যে কোন নির্দেশ পালন করা স্ত্রীর ওপর ওয়াজিব। তার সেই নির্দেশের বরখেলাপ চলা নাজায়িয, হারাম ও কবীরা গুনাহ। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি। ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল: কোন নারী উত্তম? জবাবে তিনি বললেন: ঐ নারীই উত্তম, যে নারী তার স্বামীকে আনন্দ দেয় যখন সে তার দিকে তাকায়: সে স্বামীর আনুগত্য করে, যখন সে তাকে কোন নির্দেশ দেয় এবং তার নিজের ও সম্পদের ব্যাপারে স্বামী যা অপছন্দ করে, তা প্রতিপালনে তার বিরুদ্ধাচরণ করে না" -সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ৫৩৪৩


এমনকি স্বামীর নির্দেশ মান্য করা স্ত্রীর জন্য পরকালীন সাফল্য লাভের উপায়। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-"নারীদের যে কেউ মারা যাবে এমতাবস্থায় যে, তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [জামি তিরমিজী, হাদীস নং ১১৬১ ও সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৪৫৪]


স্বামীর নির্দেশ পালন এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তা অমান্য করার কারণে আল্লাহ তা'আলা অসন্তুষ্ট হন এবং ফেরেশতাগণ তাকে লা'নত করেন। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- "যখন কোন স্বামী স্বীয় স্ত্রীকে বিছানায় আসতে আহ্বান করে, আর তার স্ত্রী সেই আহ্বান উপ্রত্যাখ্যান করে, তখন সকাল পর্যন্ত ফেরেশতাগণ ঐ স্ত্রীর উপর লা'নত (অভিশাপ) বর্ষণ করতে থাকেন।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৯৭ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৬১১]


আর এ জন্যই স্ত্রী যাতে স্বামীর আহ্বানে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিতে পারে, তাই স্বামীর অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর জন্য নফল রোযা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। এ মর্মে নবী কারীম (সা.) বলেন-"স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর জন্য সাওম (নফল রোযা) পালন করা বৈধ নয়। আর স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য কাউকে তার গৃহে প্রবেশ করতে দেবে না। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৯৯ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৪১৭]


স্বামীকে কখনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবহেলা করা যাবে না এবং কথাবাতায় এমন কিছু বলা যাবে না-যা দ্বারা তার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। কেননা, স্বামীর প্রতি মহব্বতের পাশাপাশি অগাধ ভক্তি- শ্রদ্ধা প্রদর্শনও কর্তব্য-যে কারণে স্বামীকে সম্মানের সর্বোচ্চ সোপানে অধিষ্ঠিত করে তাকে সিজদা করারও হুকুম হতো যদি তা জায়িয থাকতো বলে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন-"কোন মানুষের জন্য কোন মানুষকে সিজদা করা যদি বিধেয় হত, তবে আমি স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য সেই মহত্তর হকের কারণে যা তার উপর তার স্বামীর রয়েছে।" [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১২৬৩৫]


উল্লিখিত করণীয় ও কর্তব্যসমূহ পালনের দ্বারাই স্ত্রী তার প্রতি দ্বীনের দাবী পূরণ করতে পারে। আর এর মাধ্যমে সে ইহ ও পরকালে অভাবনীয় সাফল্য ও কল্যাণের অধিকারীণী হবে।



স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বিশেষ কর্তব্য স্ত্রী যেমন পালন করবেন, তেমনি স্বামীর জন্য নির্ধারিত বিশেষ কর্তব্য স্বামীকে পালন করতে হবে। সেই কর্তব্যের প্রধান বিষয় হচ্ছে হচ্ছে-স্ত্রীর হক ও অধিকার যথাযথভাবে আদায় করা।


স্ত্রী স্বীয় স্বামীর আনুগত্য করবে, তবে এক্ষেত্রে স্বামীকে ঔদ্ধত্য ও সীমাহীন কঠোরতা পরিহার করতে হবে। বরং হিকমতের সাথে বুঝ দিয়ে তাকে সুপথে চালাতে সচেষ্ট হতে হবে। আর তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোরপূর্বক নারীদের মালিক হয়ে বসবে। আর তাদেরকে এই উদ্দেশ্যে অবরুদ্ধ করে রেখো না যে, তোমরা তাদেরকে যা কিছু দিয়েছ তার কিয়দাংশ আত্মসাৎ করবে। অবশ্য তারা যদি প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়, তবে ভিন্ন কথা। আর তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন কর।" -সূরাহ নিসা, আয়াত : ১৯


তেমনিভাবে একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তাদের কারো প্রতি অবহেলা প্রদর্শন বা জুলুম করা খুবই অন্যায়। বরং পারতো পক্ষে তাদের সবার মাঝে সমতা ও ইনসাফ কায়িম করতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন- " তোমরা চাইলেও স্ত্রীদের মধ্যে পুরোপুরি সুবিচার ও ইনসাফ বজায় রাখতে সক্ষম হবে না, অতএব, কোন একজনকে ঝুলিয়ে রেখে অপরজনের প্রতি একেবারে ঝুঁকে পড়বে না। তোমরা যদি নিজেদের কাজকর্ম সঠিকরূপে সম্পন্ন কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, তবে আল্লাহতো ক্ষমাকারী ও দয়াময়। _সূরাহ নিসা, আয়াত : ১২৯

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url