শিশু জন্মের পর করণীয়, শিশুদের আকিকার নিয়ম, শিশুদের নাম রাখার নিয়ম ও শিশু জন্মের পর আজান দেওয়ার নিয়ম

 

শিশু জন্মের পর কি কি করণীয়

শিশুর জন্মের পর চারটি করণীয়
শিশুর জন্মের পর মা-বাবার ওপর প্রাথমিক চারটি দায়িত্ব আরোপিত হয়, যথা: আজান- ইকামত, তাহনীক, নামকরণ ও আকীকা নিয়ে এগুলো বিশ্লেষণ করা হলো-


শিশুর কানে আজান ও ইকামত দেয়া
শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, শিশুর জন্মের পর পর তার কানে অন্য কোনো কথা। বা অন্য কোনো ধ্বনি প্রবেশ করার পূর্বে ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামতের শব্দগুলো সশব্দে উচ্চারণ করা সুন্নাত।

নবজাতকের কানে আজান দেয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে তার কানে সেই মহান স্রষ্টার নাম শুনিয়ে দেয়া হচ্ছে-যিনি তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে রূপদান করেছেন।

এ ছাড়াও সেই আযানে এ শিক্ষাও রয়েছে যে, এ আজান-ইকামতের পরে কোন নামায নেই। অপরদিকে জানাযার নামাযে আযান-ইকামত নেই। এখানে যেন সেই আযানই দিয়ে রাখা হলো। সুতরাং আযান শোনার পর নামাযী ব্যক্তি যেমন দ্রুত সব কাজ গুছিয়ে নামাযের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তেমনি সকলকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কাজ-কর্মে শেষ নামাযের প্রস্তুতির কথা স্মরণ রাখতে হবে। উদাসীন হয়ে দুনিয়ার কাজে ডুবে থাকলে চলবে না।


তাহনীক করা
শিশুর মুখে কোনো খাবার দেয়ার আগে কোনো দ্বীনদার মুক্তাকী ব্যক্তি দিয়ে মিষ্টি কোনো খাবার চিবিয়ে তার রস বাচ্চার মুখে দেয়াকে তাহনীক বলে। এটা সুন্নাত।

মদীনার আনসারী সাহাবীগণ (রা.) তাদের নবজাতক শিশুদেরকে রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর খিদমতে নিয়ে আসতেন। নবীজী (সা.) আপন পবিত্র মুখে খেজুর চিবিয়ে তার থেকে একটু রস বাচ্চাদের তালুতে চুষতে দিতেন। (সহীহ মুসলিম)

এর উপকারিতা হচ্ছে-মুখে দ্বীনদার ব্যক্তির বরকত লাভ করে খাওয়া শুরু করা। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এর দ্বারা সুন্নাত আদায় হচ্ছে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত জেনে যদি আমার এটা আমল করি, তবে নিঃসন্দেহে আমরা ছাওয়াবের অধিকারী হবো এবং আমাদের জন্য সেটাই যথেষ্ট।


শিশুর নাম রাখা
শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে তার সুন্দর একটি নাম রাখা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- “জন্মের সপ্তম দিন শিশুর পক্ষ থেকে পশু জবেহ (আকীকা) করবে, তার নাম রাখবে এবং তার মাথা মুন্ডন করবে।" (জামি তিরমিযী / সুনানে আবু দাউদ)

আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন—“ তোমরা তোমাদের সন্তানদের সুন্দর নামকরণ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন সকলকে তাদের এবং তাদের পিতাদের নামে। ডাকা হবে।" (সুনানে আবু দাউদ/ মুসনাদে আহমদ)

নামের অর্থ সুন্দর ও বাস্তবমুখী হওয়ার সাথে সাথে তাতে যেন মুসলিম পরিচয়টাও ফুটে উঠে সেই খিয়াল রাখতে হবে। অনেকেই এদিকে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। তা অনুচিত অনেক মুসলিম শিশুর নাম অতুল, টুটুল, আকাশ, সৌরভ, সুবর্ণা, সেঁজুতি, সুমিতা ইত্যাদি রাখেন। এ ধরনের নাম ইসলামসম্মত নয়।

ইসলামে মুসলমানদের সব কাজ-কর্ম, আমল-ইবাদত, চাল-চলন ও সামাজিক বিধি- ব্যবস্থা সব কিছুই স্বতন্ত্র পরিচয়বাহী হওয়া আবশ্যক। বিজাতীয় বা বিধর্মী আচার-আচরণ এবং তাদের পরিচয় বহন করে এমন সবই পরিহার করে চলতে হবে। আশুরার রোযা দু'টো রাখার নির্দেশ রাসূলুল্লাহ (সা.) কেবল এজন্য দিয়েছিলেন যে, এ সময় ইয়াহুদীরা একটি রোযা রাখতো অবস্থায় মুসলমানরাও একটি রোযা রাখলে তা ইয়াহুদীদের সাথে মিলে যায়। ঠিক তেমনিভাবে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় নামকরণ উপমহাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও অন্যান্য কিছু বিধর্মী জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। তারা কখনো ভুলেও এর অন্যথা করে না। তাই সেরূপ নাম মুসলমানদের জন্য বর্জনীয়। অপরদিকে ইসলামের আবির্ভাবকাল থেকেই কুরআনের ভাষায় ও নবীজীর ভাষায় তথা আরবীতে মুসলমানদের নামকরণ হয়ে আসছে এবং দেড় হাজার বছর পরেও সঠিক বিবেক- বুদ্ধি সম্পন্ন মুসলিমের কাছে এর আবেদন এতটুকু ম্লান হয়নি। এমনকি অমুসলিম কেউ মুসলমান হলে মুবাল্লিগগণ তার নাম পরিবর্তন করে আরবী নাম রাখেন। কারণ, ইসলাম যেমন আল্লাহর নিকট মনোনীত ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন, তেমনি ইসলাম প্রতিটি মুসলিমের সব কাজ কর্মে ইসলামী ভাবধারা প্রত্যাশা করে।

এখানে আরবী নামের ব্যাপারেও একটি বিষয়ে সতর্ক করা প্রয়োজন মনে করছি। অনেক মা-বাবা কেবল কুরআনে আছে বলে সন্তানের চরম আপত্তিকর নাম রেখে থাকেন। একবার এক বাচ্চার নাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম রামীমা, আরেকজনের নাম রামীম। তৃতীয় আরেকজনের নাম রাজীম। এ ধরনের নাম রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা জানালেন, এগুলে তারা পবিত্র কুরআন থেকে চয়ন করেছেন। অথ রামীন অর্থ পঁচা এবং রাজীম অর্থ অভিশপ্ত। এটা শয়তানের সিফাত। তেমনি কেউ সন্তানদের না মলিনা (ময়লা), মাহিন। (অপমানিত), সাকরান (মাতা) ইত্যাদি রাখেন যা খারাপ অর্থবোধক তাই এক্ষেত্রে বুঝে-শুনে ভালো অর্থপূর্ণ ইসলামসম্মত নাম রাখা কর্তব্য।


আকিকা করা
শিশু জন্মের সপ্তম দিনে কোনো একটি পশু আকিকা করা সুন্নাত এবং তার মাথার চুল কেটে চুলের ওজনে রূপা সদকা করা সুন্নাত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- “প্রতিটি শিশুর জন্মের সাথে আকীকা দিতে হয়। তোমরা তাদের আকিকা দাও এবং তাদের চুল ফেলে দাও।” (সহীহ বুখারী)

হযরত হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.) এর জন্মের সপ্তম দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাগল দিয়ে তাদের আকিকা সম্পন্ন করেন। এবং হযরত ফাতিমা (রা.) কে তাদের চুল কেটে চুলের ওজনে রূপা সদকা দিতে বলেন। হযরত ফাতিমা তাদের চুল কেটে রূপা দিয়ে এর ওজন করলে, তা এক দেরহাম এর চেয়ে কিছু কম হয়, তা সদকা করে দেয়া হয়। (জামি তিরমিযী)

আরেক হাদীসে ছেলে সন্তানের জন্য দু'টি ছাগল ও কন্যা সন্তানের জন্য একটি ছাগল। আকিকা দেয়ার কথা এসেছে। তবে সামর্থে না। তুলালে ছেলের জন্য একটি ছাগল দিলেও যথেষ্ট হবে। আবার কুরবানীর পশুতে আকিকার নিয়তে শরীক হওয়াও জায়িয আছে।

আকিকার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় সকলেই খেতে পারবেন। কেউ কেউ আকিকার গোশতকে শুধু গরীবের হক মনে করেন, এটা ঠিক নয়। তবে এর গোশত গরীবদেরকে কিছু বেশী দিয়ে দেয়া ভালো।

আকীকার গোশত কাচাও বিলি করা যায়, আবার রান্না করেও খাওয়ানো যায়। তবে কোনো কোনো স্থানে কার্ড ছেপে আকিকার দাওয়াত করা হয় এবং বিশাল তোরণ ও প্যান্ডেল খাটিয়ে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হয়। অভ্যাগত মেহমানরা কে কি নিয়ে এসেছেন, তার তালিকা করা হয়। পাশাপাশি আতশবাজি, নাচ, গান, ছবি উঠানো পুরোমাত্রায়  চলে। সব মিলিয়ে তা সুন্নতী আকিকার পরিবর্তে অনৈসলামিক কালচারে পরিণত হয় যা খুবই দুঃখজনক। এটা কোনক্রমেই জায়িয নয়।

তাই আকিকা সাদাসিধাভাবে এবং নিঃস্বার্থভাবে করতে হবে। কোনো অনুষ্ঠান না করে এবং অতিথিদের থেকে কিছু পাওয়ার ইচ্ছা না করে তা আত্মীয়-স্বজনসহ ধনী-গরীব সবার মাঝে বিলিয়ে দিবেন এবং নিজেরা খাবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url