হযরত মুসা আঃ কে কয়টি মোজেজা দেয়া হয়েছিল?

 

হযরত মুসা আঃ এর মুজিজা

ولقد اتينا موسى تسع آيت بينت الآية 

“এবং অবশ্যই আমি মূসা (আ.) কে নয়টি মোজেজা দান করেছি।” (সূরা বনী ইসরাঈল-১০১)


ফেরাউনের যাদুকররা মূসা (আ.) এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাওয়ার ঘটনার পর ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী হযরত মূসা (আ.) বিশ বছর যাবৎ মিশরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর বাণী শোনান এবং সত্য ও সরল পথের দিকে আহবান করতে থাকেন। এবং এই সময়ের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ.) কে নয়টি মোজেজা দান করেন, এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ফেরাউন এর সম্প্রদায়কে সতর্ক করে সত্য সরল পথে আনা। উল্লেখিত আয়াতে উক্ত নয়টি মোজেজা সম্পর্কেই বলা হয়েছে।


এই নয়টি মোজেজার মধ্যে প্রথম দুটি মোজেজা অর্থাৎ লাঠির সাপে পরিণত হওয়া এবং হাতের আলোকময় হওয়া ফেরাউনের দরবারে প্রকাশিত হয়, আর এগুলোর মাধ্যমেই জাদুকরদের বিরুদ্ধে হযরত মুসা (আ.) জয়লাভ করেন।


তৃতীয় মোজেজাটি ছিল ফেরাউনের সম্প্রদায়ের হঠকারিতা ও দুরাচরনের ফলে দুর্ভিক্ষের আগমন, যাতে তাদের ক্ষেতের ফসল এবং বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরম ভাবে হ্রাস পেয়েছিল, ফলে তারা অত্যন্ত ব্যকুল হয়ে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত মূসা (আ.) এর মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি লাভের দোয়া করায়।


পরবর্তী মোজেজা গুলো হলো যথাক্রমে : তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, ও প্লেগ রোগ জনিত আযাব, যা আরোপিত হয়েছিল ফেরাউন সম্প্রদায়ের উপর।


ইবনে মুনযির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) এর রেওয়াত উদ্ধৃত করেছেন যে, এর প্রতিটি আযাব ফেরাউন সম্প্রদায়ের উপর সাত দিন করে স্থায়ী থাকত, শনিবার দিন শুরু হয়ে দ্বিতীয় শনিবার রহিত হয়ে যেত। এবং পরবর্তী আযাব আসা পর্যন্ত তিন সপ্তাহের অবকাশ দেয়া হত।


ইমাম বগভী (রহ.) হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, প্রথম বার যখন ফেরাউনের সম্প্রদায়ের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব চেপে বসে এবং মূসা (আ.) এর দোয়ায় তা রহিত হয়ে যায়, কিন্তু তারা তাদের ঔদ্ধত্য থেকে বিরত হয় না, তখন হযরত মূসা (আ.) আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করেন, হে আমার পরওয়ারদেগার এরা এতই ঔদ্ধত্য যে দুর্ভিক্ষের আযাবেও প্রভাবিত হয়নি, এবং নিজেদের কৃত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে। অতএব তাদের উপর এমন কোন আযাব চাপিয়ে দাও, যা হবে তাদের জন্য বেদনাদায়ক, এবং আমাদের জাতীর জন্য উপদেশ মুলক, তখন আল্লাহ তায়ালা প্রথমে তাদের উপর নাযিল করেন তুফান জনিত আযাব। মুফাসসের গণের মতে তুফান অর্থ পানির তুফান, অর্থাৎ জলোচ্ছাস, এতে ফেরাউন সম্প্রদায়ের সমস্ত ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা পানিতে ডুবে যায় । না থাকে কোথাও শোয়া-বসার জায়গা, না থাকে জমিতে চাষাবাদের কোন ব্যবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, ফেরাউন সম্প্রদায়ের সাথেই ছিল বনি ইসরাঈলদের জমি-জমা, ঘর বাড়ি অথচ তাদের জমি জমা, সবই ছিল শুষ্ক। সে গুলোর কোথাও জলোচ্ছাসের পানি ছিল না।


এই জলোচ্ছাসে ভীত হয়ে ফেরাউন সম্প্রদায় মূসা (আ.) এর নিকট প্রার্থনা করল যে, আপনার পরওয়ারদেগার এর দরবারে দোয়া করুন, যাতে এই আযাব দূর হয়ে যায়। তাহলে আমরা ঈমান আনব এবং বনী ইসরাঈলদিগকে মুক্ত করে দেব।" মূসা (আ.) এর দোয়ায় জলোচ্ছাসের তুফান রহিত হয়ে গেল এবং তারপর তাদের শস্য ফসল অধিকতর সবুজ শ্যমল হলে উঠল, তখন তারা বলতে লাগল যে, আসলে এই জলোচ্ছাস কোন আযাব ছিল না। বরং আমাদের ফায়দার জন্যই তা এসেছিল, ফলে আমাদের শস্য ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে, সুতরাং মূসা (আ.) এর এতে কোন দখল নেই। এ সকল কথা বলেই তারা তাদের কৃত প্রতিজ্ঞার প্রতি উপেক্ষা করতে শুরু করে।


এভাবে তারা মাস খানিক সময় সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। আল্লাহ পাক তাদেরকে এই সময়ের মধ্যে চিন্তা ভাবনার জন্য অবকাশ দান করলেন। কিন্তু তাদের চিন্তা চেতনার কোন পরিবর্তন হল না। তখন দ্বিতীয় শান্তি পঙ্গপালকে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হল । এই পঙ্গপাল তাদের সমস্ত শস্য, ফসল ও বাগানের ফল ফলাদী খেয়ে নিঃশেষিত করে ফেলল।


কোন কোন বর্ণনায় এটাও বর্ণিত আছে যে, কাঠের দরজা জানালা, ছাদ প্রভৃতি সহ ঘরে ব্যবহার্য সমস্ত আসবাব পত্রও পঙ্গপালেরা খেয়ে শেষ করে ফেলেছিল, আর এ আযাবের ক্ষেত্রেও মূসা (আ.) এর মোজেযা পরিলক্ষিত হয় যে, এই সমস্ত পঙ্গপাল শুধু মাত্র ফেরাউনের সম্প্রদায়ের শস্য ক্ষেত ও ঘরবাড়িতে ছেয়ে গিয়েছিল । কিন্তু সাথেই ইসরাঈলীদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি ও বাগবাগিচা ছিল সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।


আবার ফেরাউন সম্প্রদায় আর্তচিৎকার করে মূসা (আ.) এর নিকট আবেদন জানালো যে, এবার আপনি দোয়া করে আযাব সরিয়ে দিন, আমরা ওয়াদা করছি ঈমান আনব এবং বনী ইসরাঈল দিগকে মুক্তি দিব। অতঃপর মূসা (আ.) দোয়া করলেন, আযাব সরে গেল, কিন্তু আবার তারা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল। ঈমানও আনল না, বনী ইসরাঈল দিগকে মুক্তিও দিল না। আবার তাদেরকে আল্লাহ পাক এক মাসের অবকাশ দান করলেন। অবকাশের পরে তাদের উপর চাপিয়ে দিলেন, তৃতীয় আযাব قمل (কাম্মাল) قمل মানুষের চুলে বা কাপড়ে জন্ম নেয়া উকুন কেও বলা হয়, এবং সে সব পোকা বা কীট কেও বলা হয়, যা কোন কোন সময় খাদ্য শস্যে পড়ে। যাকে সাধারণত: ঘুন এবং কেরী পোকাও বলা হয়। কোম্মালের এ শাস্তিতে সম্ভবত উভয় ধরনের পোকাই অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের শস্য ক্ষেতেও ঘুন ধরেছিল এবং মাথায়ও উকুন হয়েছিল বিপুল পরিমানে।


সে ঘুনের ফলে খাদ্য শস্যের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, দশ সের গম থেকে তিন সের আটাও হতো না। আর উকুন তাদের চুল-ভ্রু পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছিল । ফলে আবার শুরু হল ফেরাউন সম্প্রদায়ের কান্না কাটি। অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে মূসা (আ.) এর নিকট এসে ফরিয়াদ করল, এবার আর আমরা ওয়াদা ভঙ্গ করব না, আপনি দোয়া করুন, মূসা (আ.) এর দোয়ায় এ আযাবও চলে গেল, কিন্তু এবারও তারা প্রতিজ্ঞা পূরন করল না, বরং অব্যাহতি লাভের সাথে সাথে সবই ভুলে গেল এবং অস্বীকার করে বসল, বরাবরের ন্যায় আবার তাদেরকে এক মাসের সময় দেয়া হল, কিন্তু তারা এই অবকাশেরও কোন সুযোগ নিল না। তখন চতুর্থ আযাব হিসেবে হাযির হল ব্যঙ, এতে তাদের ঘর বাড়িতে এত অধিক সংখ্যায় ব্যঙ জন্মালো যে, কোন খানে বসতে গেলে গলা পর্যন্ত উঠত ব্যঙের স্তূপ, শুতে গেলে ব্যাঙের স্তূপের নীচে তলিয়ে যেতে হতো, রান্নার হাড়ি, আটা চালের মটকা সব কিছুই ব্যাঙে ভরে যেত । এই আযাবে অসহ্য হয়ে সবাই বিলাপ করতে লাগল এবং আগের চেয়েও পাকা পাকি ওয়াদার পর হযরত মুসা (আ.) এর দোয়ায় এ আযাও দূর হল।


কিন্তু এর পরও কি তাদের কোন পরিবর্তন হলো? হলো না, বরং তারা বলতে আরম্ভ করল যে, এবার তো আমাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়ে গেল যে, মূসা (আ.) মহা যাদুকর। আর এ সবই তাঁর যাদুর কীর্তি কাণ্ড।


অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আরেক মাসের জন্য তাদেরকে অবকাশ দিলেন। কিন্তু তারা এ সুযোগও নিল না, তখন এল পঞ্চম আযাব রক্ত। তাদের সমস্ত পানাহারের বস্তু রক্তে রূপান্তরিত হয়ে গেল। কূপ কিংবা হাউস থেকে পানি তুলে আনলে তা তৎক্ষণাত রক্ত হয়ে যেত।


এই সকল প্রত্যেকটা আযাবের ক্ষেত্রেই হযরত মূসা (আ.) এর মোজেযা বরাবর প্রকাশ পেতে থাকে যে, প্রত্যেকটা আযাব থেকেই ইসরাঈলীরা তাদের সংলগ্নে থাকা সত্ত্বেও থাকে মুক্ত ও সুরক্ষিত।


অতঃপর এ আযাবও পূর্ববর্তী আযাবের ন্যায় সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হল, এতে আবার দুরাচার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী ফেরাউন সম্প্রদায় চীৎকার করতে লাগল এবং হযরত মূসা (আ.) এর নিকট ফরিয়াদ করল এবং অধিকতর দৃঢ় ভাবে ওয়াদা করল। দোয়া করা হলে এ আযাবও সরে গেল, কিন্তু তারা তেমনি গোমরাহীতে স্থীর থাকল।


অতঃপর ষষ্ট আযাব হিসেবে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হল প্লেগের মহামারী যাতে তাদের সত্তুর হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছিল। তখন আবারও তারা নিবেদন করে এবং শেষ পর্যন্ত দোয়া করা হলে প্লেগের আযাবও চলে যায়, কিন্তু তারা যথারীতি ওয়াদা ভঙ্গ করে। ক্রমাগত এতবার পরিক্ষা ও অবকাশ দানের পরেও যখন তাদের কোন পরিবর্তন হল না, তখন তাদের উপর আসে সর্বশেষ আযাব, আর তাহল তারা নিজেদের ঘর বাড়ি, শস্য ক্ষেত, বাগ-বাগিচা ও আসবাব পত্র ছেড়ে মূসা (আ.) এর পশ্চাদ্ধাবন এর উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে, শেষ পর্যন্ত লোহিত সাগরের গ্রাসে পরিণত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url