মহিলা মাদ্রাসার প্রয়োজনীয়তা ও একটি আদর্শ মহিলা মাদ্রাসার আবশ্যিক কিছু গুনাবলী

 

মহিলা মাদ্রাসা

الحمد لله رب العالمين _ والعاقبة للمذقين والصلاة والسلام على سيدنا محمد واله واصحابه اجمعين _

নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়াম পালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।

-সূরা আহযাব: ৩৫


বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভাল কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আনুগত্য করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের। এদেরই উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন।

-আত-তাওবা: ৭১


হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে মহিলা (১) পাঁচ ওয়াক্ত নামায (নিয়মমত) আদায় করবে, (২) রমযানের রোযা (ঠিকমত) রাখবে, (৩) লজ্জাস্থান হেফাযত করবে এবং (৪) স্বামীকে মান্য করবে, তাকে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, যে দরজা দিয়ে মন চায় সে দরজা দিয়ে তুমি বেহেশতে প্রবেশ কর।

-মিশকাত


ইসলাম সম্পর্কে যারা অবগত আছেন তারা জানেন যে শরীয়তের অধিকাংশ হুকুম আহকাম ও বিধি-বিধান এর ব্যাপারে নারী ও পুরুষ সমপর্যায়ের।

যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, কোরবানী, ব্যবসা-বানিজ্য, হালাল-হারাম, বিবাহ-শাদী ইত্যাদি বিষয়।


আর ইসলামের বিধি-বিধান গুলো এতই ব্যাপক যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া শুধু ঘরে বসে বই পড়ে এসব বিষয় অনুধাবন করা ও পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব নয়। এ কারনেই যুগে যুগে উম্মতে মুহাম্মদীকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দ্বীনি মাদ্রাসা। তবে এসবের বেশিরভাগই ছিল পুরুষদের জন্য। ইসলামের সোনালী যুগের নারীদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও নারীগণ নিজ আগ্রহে অথবা পারিবারিক ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে ঘরোয়া পরিবেশে প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষা গ্রহন করে নিতেন।


কিন্তু পরিবেশ ও সমাজের পরিবর্তনের কারনে নারীদের ধর্মীয় শিক্ষার দ্বারগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে নারীরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। যার ফলে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাপনায় একটা অস্থির পরিস্থিতির সৃস্টি হয়। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে মুসলিম পরিবারের মেয়েরাও বাধ্য হয়ে জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হচ্ছে। যেখানে নেই প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা, নেই জীবন ও যৌবনের নিরাপত্তা। যেখানে মেয়েরা পাচ্ছে না প্রকৃত শিক্ষা বরং সেখানে রয়েছে সর্বদা বিপদের আশস্কা।


ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে নারীদের মধ্যে বেপর্দা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ইত্যাদি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কি নারীদের অনেকেই কুরআন মাজিদ দেখে পড়া কিংবা সালাত (নামায) আদায়ের জন্য আবশ্যকীয় সূরা গুলোও শিখতে পারছেনা। এহেন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের পরামর্শে বাংলাদেশে মহিলা মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠার শুরুলগ্নে কিছু প্রসিদ্ধ আলেম বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে মহিলা মাদ্রাসার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের বিরোধিতার উল্লেখ্যযোগ্য কিছু কারণও ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বিরোধীতা এবং সমস্যাগুলো অতিক্রম করে মহিলা মাদ্রাসার অগ্রসরমান যাত্রা শুরু হয়। এবং এর সুফল প্রত্যক্ষ করে আলেম সমাজ এবং সাধারণ মুসলমানরা মহিলা মাদ্রাসার দিকে ঝুকে পড়েন এবং নারীদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহনের প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়।


একথা সবারই জানা যে, একজন মা হচ্ছেন শিশুর প্রথম শিক্ষক। তিনি যদি ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানবতী হন এবং পর্দানশীন হন তাহলে সন্তানও ধার্মিক হবে আশা করা যায়। এছাড়া ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী একজন মা তার সন্তানকে পারিবারিক, সামাজিক শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে তাকে একজন আদর্শ সন্তান ও একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।


একটি আদর্শ মহিলা মাদ্রাসার আবশ্যিক কিছু গুনাবলী
১। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় নিয়তের বিশুদ্ধতাঃ প্রত্যেক কাজের ফলাফল বা পরিণাম নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সকল কাজের বিশুদ্ধতা এবং প্রতিফল তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং নিয়তের আছর বা প্রতিক্রিয়া আমল এবং আমল কারী উভয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং মাদ্রাসা নির্মাণে প্রতিষ্ঠাতার ইখলাস ও নিয়তের বিশুদ্ধতা মহিলা মাদ্রাসাকে একটি মাকবুল দ্বীনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।


২। দক্ষ ও মুত্তাকী শিক্ষক শিক্ষিকাঃ মহিলা মাদ্রাসার সিলেবাস এবং পুরুষ মাদ্রাসার সিলেবাস প্রায় একই। অপরদিকে মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপনীর কাল ছেলেদের তুলনায় কম। তাই পুরুষ মাদ্রাসার মতোই মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক শিক্ষিকাদেরকেও যথেষ্ট যোগ্য এবং পরিশ্রমী হতে হবে। অন্যথায় ছাত্রীরা সঠিকভাবে দ্বীন শিখতে ব্যর্থ হবে। অনেক ক্ষেত্রে মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগে যোগ্যতার বিষয়টি চরমভাবে অবহেলা করা হয়। এর কারনে মহিলা মাদ্রাসার উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।


৩। শতভাগ শরয়ী পর্দার বাধ্যবাধকতাঃ পর্দা মহিলা মাদ্রাসার প্রাণ। মূলত পর্দা শিখা, নারী জাতিকে পর্দানশীল জাতিতে পরিণত করা এবং পর্দাহীনতার বেহায়াপনা থেকে বাঁচানোর জন্যই মহিলা মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠার একটা বড় উদ্দেশ্য। পর্দাহীনতা অনেক গুনাহের মূল উৎস। সুতরাং মহিলা মাদ্রাসায় পর্দার নিশ্চয়তা থাকতে হবে শতভাগ। মহিলা মাদ্রাসার ব্যাপারে বড় বড় আলেমদের যে আপত্তি এসেছে তার বেশিরভাগই হচ্ছে পর্দাহীনতার আশংকার কারনে। মনে রাখতে হবে, মাদ্রাসায় কেউ গুনাহ করতে আসেনি বরং দ্বীন শিখার জন্য এসেছে। পর্দাহীনতা মহিলা মাদ্রাসার মাকসাদ কে ধ্বংস করবে।


৪। পর্যাপ্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থাঃ আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার জন্য পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা ও যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা থাকা আবশ্যক। যাতে ছাত্রীদের গাদাগাদি করে ক্লাসে বসতে না হয় এবং রাতে ঘুমাতে না হয়। পড়ালেখার জন্য সুস্থ শরীর ও মন আবশ্যক। সুন্দর পরিবেশ শরীর ও মনকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। আবাসিক মাদ্রাসার বড় সুবিধা হলো মাদ্রাসার দ্বীনি পরিবেশ। দ্বীন শিখা ও আমল করার জন্য দ্বীনি পরিবেশে অবস্থান একটি অপরিহার্য বিষয়। মাদ্রাসার দ্বীনি পরিবেশে থাকলে পড়ালেখা যেমনিভাবে হবে তেমনি প্রাত্যহিক আমল তথা নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, পর্দা ইত্যাদি আদত বা অভ্যাসে পরিণত হবে খুব সহজে, যেটা বাড়ীর পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।


৫। লেখাপড়ার সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশঃ মাদ্রাসা হচ্ছে দ্বীন শিখার জায়গা। দ্বীন না শিখলে আমল করবে কিভাবে ? তাই আমল করে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে ইলমে দ্বীন শিখতে হবে। গল্পগুজব আর হাসি তামাশার পরিবেশে তো আর লেখাপড়া হবেনা বরং এতে জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় হবে। খুপড়ি একটা পেলাম তো ভাড়া নিয়ে মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে মুহতামিম বনে যাব- এ জাতীয় মন-মানসিকতা বর্জন করতে হবে। মহিলা মাদ্রাসাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদলেই গড়ে তুলে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।


৬। লেখা পড়ার সাথে আমল ও আখলাকের সুষ্ঠু সমন্বয়ঃ মানুষের অপর নাম চরিত্র। চরিত্রই মানুষ। ভালো চরিত্রের একজন লোক মারা গেলে আলোচনা হয় একজন মানুষ মারা গেছে। পক্ষান্তরে মন্দ চরিত্রের কেউ মারা গেলে লোকেরা বলে একটা অমানুষ মারা গেছে। কোরআন হাদীস হচ্ছে উত্তম চরিত্রের উৎস। সুতরাং কোরআন ও হাদীসের গুণাবলীর আলোকে ছাত্রীদের জীবন গড়ে দেওয়াও মাদ্রাসার একটা প্রধান কাজ। প্রশিক্ষণটা তো এমন হওয়া চাই যে, বাসায় বাড়ীতে সবাই বলবে : মাশাআল্লাহ একজন মাদ্রাসার ছাত্রী।

এসকল বিষয় যদি যথাযথভাবে একটা মাদ্রাসায় থাকে তাহলে কোন মহিলা মাদ্রাসা ফিতনায় পরিণত হবে না।


মহিলা মাদ্রাসার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। মেয়েদের দ্বীন শেখাতে মহিলা মাদ্রাসার অবদান আজ অনস্বীকার্য। প্রকৃত দ্বীন মুসলিম ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিতে মহিলা মাদ্রাসা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি ইসলামকে চিরতরে মুছে দিতে জাগতিক শিক্ষার মাধ্যমে যে পাঁয়তারা চালাচ্ছে তা আজ অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে মহিলা মাদ্রাসা সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার কারনে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url