নবীওয়ালা কাজ কাকে বলে, ও কোরআনের আলোকে নবীওয়ালা কাজ
ইসলামের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে আল্লাহ তাআলা হেদায়েত এর দুটি পদ্ধতি নিদৃষ্ট করে দিয়েছেন । দুটির সমন্বয় ঘটলেই সরল পথের হেদায়েত নসিব হয়। অন্যথায় গোমরাহী থেকে যায়। একটি হলো আল্লাহর কিতাব যা যুগের চাহিদা অনুযায়ী রাসূলের উপর অবতীর্ণ হয়েছে । দ্বিতীয়টি হলো ওই ব্যক্তিত্ব যার মাধ্যমে ঐ কিতাবের বিধানের পরিচয় লাভ হয় । এই দুটি পদ্ধতি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল। সর্বশেষ যখন আল্লাহ তাআ'লা আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন তখন তার উপরে সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল কোরআন অবতীর্ণ করলেন। যাতে কোরআনের হাকীকত, উদ্দেশ্য তিনি মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন।
هو الذي بعث في الأميين رسولا منهم يذلو عليهم آيـاده ويزكيهم ويعلمهم الكذاب والحكمة وإن كانوا من قبل لفي ضلال مبين
এমনিভাবে এই আয়াতের সমার্থক আরও তিনটি আয়াত রয়েছে। যথাক্রমে সূরা বাকারার ১২৯, ১৫১, সূরা আল ইমরানের ১৬৪ নং আয়াত। এই ৪ টি আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দায়িত্ব ও কর্তব্য কী তার বর্ননা দিয়েছেন।
নবীওয়ালা কাজঃ নবীরা যে কাজ করেছেন সে কাজকে নবীওয়ালা কাজ বলে। বর্ণিত আয়াত গুলোর দ্বারা বুঝা গেল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাজ ছিল চারটি। যথা-
আয়াতের তিলাওয়াত: আয়াতের তিলাওয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের শব্দসমূহ এবং তার উচ্চারণ করার পদ্ধতি শিখাবেন। বুঝা গেল কুরআনের তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া নবীর একটি কাজ ছিল। সুতরাং কোরআন তিলাওয়াতের শিক্ষা দেওয়ার জন্য যত মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে কোরআন মাজিদ শিখানো হয়, যেখানে হাফেজে কোরআন তৈরী করা হয় তারা সকলেই নবীওয়ালা কাজে নিয়োজিত। তারা নবী প্রেরনের উদ্দেশ্য আঞ্জাম দিতেছেন। সুতরাং মাদ্রাসা শিক্ষাকে তুচ্ছ মনে করা নবুয়তের উদ্দেশ্য পরিপন্থী। এত কুফর-এর আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে আকীদা সহীহ করে নিতে হবে।
তাজকিয়ায়ে নফসঃ তাজকিয়ায়ে নফস এর ব্যাখ্যা হচ্ছে অন্তরকে খারাপ আকীদা,মন্দ আখলাক, মন্দ আমল থেকে পবিত্র করা । তাজকিয়ায়ে নফস অর্থাৎ আত্মা পরিশুদ্ধ করা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম দায়িত্ব ছিল। এ দায়িত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন ”তিনি তাদের আত্নাকে পরিশুদ্ধ করেন”। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামদের অন্তরকে কুফর শিরক এবং পাপাচারের কালিমা থেকে পরিশুদ্ধ করেছেন।
২। আহলে হক, কোরআন সুন্নাহর অনুসারী পীর মাশায়েখদের খানকা: এখানেও কাজ করেন ইলমে দ্বীনের ধারক বাহক ওলামায়ে কেরাম যারা আল্লাহওয়ালা, বুযুর্গ, দুনিয়া বিমুখ আলেমে দ্বীনের সান্নিধ্যে থেকে প্রথমে নিজের নফসকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং নফসকে আল্লাহর ইশকের আগুনে জ্বালিয়ে শরীয়তের অনুগত বানিয়েছেন। তারপর তারা সাধারণ সানুষ ও আলেম ওলামাদের উপর মেহনত শুরু করেন। এ সকল আল্লাহওয়ালাদের সোহবত ও সান্নিধ্যে থেকে অসংখ্য মানুষ দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করছে এবং পাপাচারের নাপাকী ও অহংকার থেকে মানুষ পরিশুদ্ধ হচ্ছে। সেখানে অসংখ্য মানুষ দ্বীনের হিদায়াত অর্জন করছে। সুতরাং পীর মাশায়েখদের এই মেহনতও নবীওয়ালা কাজ।
কিতাবের শিক্ষাদান: কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য কোরআনে কারীম এই কোরআনে কারীম এর সঠিক অর্থ ব্যাখ্যা কী হবে সাহাবাদেরকে নবী আলাইহিস সালাম শিক্ষা দিয়েছেন। আরবি ভাষার কোরআন বোঝার জন্য আরবী বলতে পারা যথেষ্ট ছিল না। যেভাবে আল্লাহ তাআলা কুরআন পাকের দায়িত্ব নিয়েছেন ঠিক তেমনিভাবে পবিত্র কোরআনে সঠিক অর্থ কী হবে তা আল্লাহ তা'আলা নিজেই বর্ণনা করে দিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলা থেকে কোরআনের সঠিক অর্থ শিক্ষাগ্রহন করে সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন পরবর্তীতে যুগে যুগে ওলামায়ে কিরাম কোরআনের সঠিক অর্থ ও মর্ম মানুষদেরকে শিক্ষা দেয়ার মহান কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
হিকমত শিক্ষাদান: হিকমত শিক্ষাদানের দ্বারা উদ্দেশ্য হল হাদিস শিক্ষাদান, শরীয়তের শিক্ষাদান অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা কাজ ও সমর্থন এর মাধ্যমে দ্বীনের সকল মাসায়েল আহকাম বর্ণনা করে দিয়েছেন। এবং সকল কাজে আল্লাহর পছন্দনীয় তরীকা তথা সুন্নত তরিকা কি তাও বর্ণনা করেছেন। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত শিক্ষা দেওয়াও নবী ওয়ালা কাজ । এই কাজটি যথাযথভাবে ওলামা কেরাম আঞ্জাম দিতেছেন এবং নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতেছেন। আর এই উলামায়ে কেরাম হচ্ছেন নবী আঃ এর উত্তরসূরী, নায়েবে রাসূল ।
আর এই কাজগুলোর জন্য যেহেতু উপযুক্ত স্থানের প্রয়োজন তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইশারায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দারুল উলূম দেওবন্দ তারপরে বাকি সকল মাদ্রাসাগুলো। তাই এই মাদ্রাসাগুলোকে দ্বীনের মারকায মনে করা জরুরি।
মাদ্রাসা নামে দ্বীনি মারকাযগুলোতেই পূর্ণ কুরআনের শিক্ষা ও তাবলীগের কাজ করা হয়। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে পূর্ন কুরআনের তাবলীগ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেমনঃ সূরায়ে মায়েদাহ এর ৬৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
يا أيها الرسول بلغ ما أنزل إليك من زبك وإن لم افعل فما بلغة رسالة
হে রাসূল আপনার প্রতিপালকের পক্ষ আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন।
উক্ত আয়াত দ্বারা সু-স্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছে রাসূল (সাঃ) এর কাজ ছিল পূর্ণ কুরআনের তাবলীগ করা আর রাসূল (সাঃ) এই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছেন এবং বিদায় হজ্জ্বে সাহাবাগণের থেকে তার স্বাক্ষ্যও গ্রহন করেছেন। পরবর্তীতে পূর্ন কুরআনের তাবলীগের কাজ বা দায়িত্ব উম্মতের উপর ন্যস্ত হয় যা সকল যুগের একমাত্র ওলামায়ে কেরামগণই উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য কে বাস্তবায়ন করেছেন। সাধারণ লোকেরা পূর্ণ কোরআনের তাবলীগের কাজ কোন যুগেই করেনি, করেছেন শুধু উলামায়ে কেরাম। সাধারণ মানুষ এই কাজ করতেও সক্ষমও নয়। কারণ যাদের কাছে পূর্ন কুরআনের শিক্ষাই নেই তারা কিভাবে পূর্ন কুরআনের তাবলীগের কাজ করবে?
বর্তমান যুগেও উলামায়ে কেরামগণই পূর্ণ কোরআনের তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন অথচ কিছু সাধারণ মানুষ সামান্য তাবলীগের কাজ করে নিজেদের কে একমাত্র তাবলীগী বলে প্রচার করছে, আর যারা পূর্ন কুরআনের পূর্ন তাবলীগ করতেছেন তাদের উপর অভিযোগ তোলেন যা একজন খাঁটি ও মুখলিছ তাবলীগ ওয়ালার কাজ হতে পারে না।
প্রচলিত তাবলীগ জামাত এবং উলামায়ে কেরাম: প্রচলিত তাবলীগ জামাতও একজন আলেমের দ্বীনী ফিকিরের ফল। একজন আলেমেরই উম্মতের প্রতি বেশী দরদ হওয়ার কথা। কারণ তিনি তো নবীর ওয়ারিস। সেই দরদের পরিপ্রেক্ষিতে দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতি সন্তান মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এই জামাতের সূচনা করেছেন এবং নবীদের দাওয়াতের তরীকার আদলেই এই জামাত পরিচালনা করেন। এর পর উলামায়ে কেরামের ব্যাপক অংশগ্রহন ও তাদের মেহনতের ফলে তাবলীগ জামাত সারা পৃথিবীতে গ্রহনযোগ্যতা লাভ করেছে। অসংখ্য সাধারণ মানষ এই মাকবূল জামাতের অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন এবং এই জামাত দ্বারা উম্মতের বিশাল অংশ কুফর, শিরক ও গোমরাহী থেকে মুক্তি লাভ করেছে।
অতএব, “উলামায়ে কেরাম তাবলীগ করেন না, দ্বীনের কাজ করেন না” সাধারণ মানুষের এই ধরনের অভিযোগ নিতান্তই মূর্খতাসুলভ কথা এবং দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতার নামান্তর। তাবলীগের উদ্দেশ্য একজন মানুষকে দ্বীন,আমল ও আখেরাতমুখী করা। সুতরাং যত জায়গাতেই এই কাজ হয় তারা সবাই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেন, নবীওয়ালা কাজ করেন। কারো দ্বীনী মেহনতকে অস্বীকার করা, হেয় বা ছোট মনে করা খুবই মন্দ কাজ। এ ধরনের মানসিকতা ইসলামেরর ক্ষতি সাধনই করবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেকের দ্বীনী মেহনতকে কবুল করুন। আমীন।